বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ পর্ব-৪


কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ
(৪র্থকিস্তি)
৯ম দলীল :হাদীছেএসেছে,
ইরবায ইবনু সারিয়াহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের উপর আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হেদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তোমরা তা মাঢ়ির দাঁত দিয়ে শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরবে।(ছহীহ ইবনু মাজাহ, তাহক্বীক্ব আলবানী, হা/৯৭।)

অন্য হাদীছে এসেছে, হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা আমার পরে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-এর আনুগত্য কর।(তিরমিযী, হা/৪০২৩।)

উল্লেখিত হাদীছদ্বয়ে যেহেতু খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার এবং বিশেষ করে আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেহেতু এখানে তাক্বলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়েছে।

জবাব :১- তাক্বলীদ পন্থীরা প্রথমেই উল্লেখিত হাদীছ দুটির বিরোধিতা করেছে।যেমন তাদের কতিপয় বিদ্বান আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করাকে নাজায়েয বলে উল্লেখ করে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর তাক্বলীদ করা ওয়াজিব বলেছেন। (আবু আব্দুর রহমান সাঈদ মাশাশাহ, আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবাআহ, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, পৃঃ১০৩।)

২- উল্লেখিত হাদীছে নির্দেশ করা হয়েছে যে, যখন কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিবে তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। এতে সঠিক ফায়ছালায় উপনীত হতে নাপারলে খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি ও মাযহাবের অনুসরণ করার নির্দেশ নেই।

৩- উল্লেখিত হাদীছে দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তাক্বলীদপন্থীরা দ্বীনের বিধান মানার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করে থাকে, যা বিদআত । (ইবনুল কাইয়েম, ইলামুলমুয়াক্কিঈন, ২/১৭৩।)

৪- ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, আমরা জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সক্ষমতার বাইরে কোন নির্দেশ দেননি। এরপরেও খুলাফায়ে রাশিদীনের মধ্যে তীব্রমতভেদ লক্ষ্য করা যায়, যা তিনটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

(ক) মতভেদ সম্বলিত বিষয়ের সকলমতকে গ্রহণ করা ইসলামী শরীআতে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আবার কোন ব্যক্তির পক্ষে পরস্পরবিরোধী দুটি মতকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যেমন আবু বকর (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ)-এর মতে দাদার উপস্থিতিতে ভাইয়েরা পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিছ হবেনা। ওমর (রাঃ)-এর মতে দাদা এক-তৃতীয়াংশ পাবে এবং বাকী সম্পদ ভাইয়েরা পাবে। আর আলী (রাঃ)-এর মতে দাদা এক-ষষ্টাংশ পাবে এবং বাকীসম্পদ ভাইয়েরা পাবে। অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি মতভেদ সম্বলিত বিষয়ে কোন ব্যক্তির পক্ষে সকলমতকেই গ্রহণকরা সম্ভবনয়। অতএব এইদৃষ্টিভঙ্গি বাতিল।

(খ) কোন একটি মতকে গ্রহণ করে বাকী মতগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা। এটাও ইসলাম বহির্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা আমাদের জন্য কেবল আল্লাহ তাআলার বিধানকে গ্রহণ করা ওয়াজিব। নিজের ইচ্ছামত কেউ কোন হারামকে হালাল এবং কোন হালালকে হারাম করতে পারেনা। কারণ দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আজ হতে আমি তোমাদের দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিলাম (মায়েদাহ৩)
তিনি অন্যত্র বলেন, এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করনা। আর যারা আল্লাহর সীমারেখা সমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম (বাকারাহ২২৯)
তিনি অন্যত্র বলেন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবেনা (আনফাল৪৬)। উল্লেখিত আয়াতগুলো এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অতএব আল্লাহ তাআলা যা হারাম করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত হারাম, যা ওয়াজিব করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ওয়াজিব এবং যা হালাল করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত হালাল বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে যদি কোন একজন খলীফার মতকে গ্রহণ করা হয়, তাহলে অপর খলীফার মতকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। এক্ষেত্রে আমরা খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্যশীল হতে পারবনা এবং উল্লেখিত হাদীছের বিরোধিতা অথবা অস্বীকার করা হবে।

(গ) খুলাফায়ে রাশিদীন যে বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তা গ্রহণ করা। আর তা গ্রহণীয় হবেনা যদি অন্যান্য ছাহাবীগণ তাঁদের সাথে ঐক্যমত পোষণ না করেন এবং তাদের মত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুকূলে না হয়। (ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ৮০৫।)
ইবনু হাযম (রহঃ) আরো বলেন, খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্য করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশের দুটি অর্থ হতে পারে। যথা-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে বাদ দিয়ে তাঁদের মন মত সুন্নাত তৈরী করা বৈধ করেছেন। আর এটা কোন মুসলিমের কথা হতে পারেনা। যে ব্যক্তি এটা জায়েয করবে সে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যাবে, তার জান-মাল হালাল বলে গণ্য হবে। কেননা দ্বীন ইসলামের সকল বিধান ওয়াজিব কিংবা ওয়জিব নয়, হালাল অথবা হারাম। মূলত দ্বীনের মধ্যে এর বাইরে কোন প্রকার নেই।
অতএব যে ব্যক্তি খুলাফায়ে রাশিদীনের এমন কোন সুন্নাত তৈরী করাকে বৈধ মনে করবে, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত বলে গণ্য করেননি, সে এমন কিছুকে হারাম করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগেতাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হালাল ছিল।অথবা এমন কিছুকে হালাল করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম করেছেন।অথবা এমন কিছুকে ওয়াজিব করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওয়াজিব করেননি।অথবা এমন কোন ফরযকে ছেড়ে দিবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফরয করেছেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছাড়েন নি।এসব কিছুকে যদি কেউ বৈধ মনে করে, তাহলে সে কাফির-মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে, যা উম্মাতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত ।এক্ষেত্রে কোন মতভেদ নেই। অতএব এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল। (ঐ, পৃঃ৮০৬।)
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উল্লেখিত হাদীছদ্বারা এই নির্দেশ ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন,
যদি এই নির্দেশ ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়, তাহলে তাদের দ্বন্দ্বের অবসান হল।আর পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যা নির্দিষ্ট সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়।( ঐ।)
৫- আবু বকর ও ওমর (রাঃ) সহ বাকী খলীফাদের আনুগত্য করা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। আর শারঈ দলীল ছাড়া এই আনুগত্য অন্য কারো দিকে নিয়ে যাওয়া বৈধ নয়। (ঐ।)
১০ম দলীল :তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, উবাই ইবনু কাব (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ বলেছেন,  তোমার নিকটে (দলীল) স্পষ্ট হলে তুমি তা আমল কর। আর (দলীল) অস্পষ্ট হলে আলেমের নিকটে অর্পণ কর।(আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবাআহ, পৃঃ১০৭।)

জবাব :উল্লেখিত আছারটিই তাক্বলীদপ ন্থীদের দাবীকে খন্ডন করার এক শক্তিশালী দলীল। কেননা উবাই ইবনু কাব (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ বলেছেন,  তোমার নিকটে (দলীল) স্পষ্ট হলে তুমি তা আমল কর। অথচ তাক্বলীদ পন্থীদের নিকটে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত স্পষ্ট হওয়ার পরেও তারা অনুসরণীয় ব্যক্তি বা মাযহাবের কোন রায় বা মতকে ছেড়ে রাসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে আসেনা। বরং রাসূলের সুন্নাতকে উপেক্ষা করে তার উপরই আমল করতে থাকে এবং তা দ্বারাই ফৎওয়া প্রদান করে। পরের অংশে বলা হয়েছে,  আর (দলীল) অস্পষ্ট হলে আলেমের নিকটে অর্পণ কর। অথচ তাক্বলীদ পন্থীরা কোন মাসআলাকে তার যোগ্য আলেম তথা রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের নিকটে অর্পণ করেনা, যারা দ্বীনের ব্যাপারে অধিকজ্ঞাত। বরং তারা তাঁদের কথাকে উপেক্ষা করে অনুসরণীয় মাযহাবের মতের উপরেই অটল থাকে। (ইলামুলমুয়াক্কিঈন২/১১৭।)
১১তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই ফৎওয়া প্রদান করতেন। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ছাহাবীদের কোন কথা দলীল হতে পারেনা, সেহেতু এটা অকাট্য তাক্বলীদ।

জবাব : ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর প্রদত্ত ফৎওয়া প্রচার করতেন মাত্র। তাদের মনমত ফৎওয়া প্রদান করতেননা। তাঁরা বলতেন, রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি একাজ করেছেন, তিনি নিষেধ করেছেন ইত্যাদি। তাঁরা কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করতেন না, যেমন তাক্বলীদ পন্থীরা করে, যদিও তা সুন্নাত বিরোধী হয়। (ইলামুলমুয়াক্কিঈন২/১৭৮, ইমামশাওকানী, আল-ক্বাওলুলমুফীদপৃঃ৩৬-৩৭।) 

১২তম দলীল : ইবনু যুবাইর (রাঃ) হতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দাদা এবং ভাইয়ের অংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলেন। জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যদি আমি কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবু বকরকেই বন্ধুরূপে গ্রহণক রতাম।(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, বাংলাঅনুবাদ, হা/৫৭৬৫।) আর আবু বকর (রাঃ) দাদাকে বাবার স্থলাভিষিক্ত বলেছেন।অতএব এখানে ইবনু যুবাইর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করেছেন।

জবাব : এখানে এমন কিছু নেই, যা দ্বারা তাকবলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়। কেননা ইবনু যুবাইর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর কথাকে অধিক ছহীহ হওয়ার কারণে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।অতএব ইবনু যুবাইর (রাঃ) স্পষ্ট শারঈ দলীলের উপর আবু বকর (রাঃ)-এর কথাকে প্রাধান্য দেননি যেমন তাক্বলীদ পন্থীরা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। (ইলামুলমুয়াক্কিঈন২/১৭৯।)

১৩তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, যেমন সাত প্রকার ক্বিরাআতের মধ্যে যে কোন এক প্রকারের ক্বিরাআতে কুরআন তেলাওয়াত জায়েয, তেমনি চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয। এদুটির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

জবাব :এই যুক্তি স্পষ্ট ভুল। কেননা সাত প্রকার ক্বিরাআত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হতে মুতাওয়াতির সূত্রে প্রমাণিত। আরবদের বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কুরআন তেলাওয়াত সহজ করার জন্য তিনি সাত প্রকার ক্বিরাআতের অনুমোদন দিয়েছেন। আর এই কারণে প্রত্যেক মুসলিমের উপর যে কোন এক প্রকারের ক্বিরাআত জায়েয। কিন্তু প্রচলিত চার মাযহাব শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয় এবং প্রত্যেকটি মাযহাবের মধ্যে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। (মুহাম্মাদ ঈদ আববাসী, বিদআতুত তায়াছ্ছু বিল মাযহাবী১/৯৫।)

১৪তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, যেমন অন্ধ ব্যক্তির ছালাতের সময় ও ক্বিবলা নির্ধারণের জন্য অন্যের তাক্বলীদ করা ও নৌকা আরোহীর ছালাতের সময় ও ক্বিবলা নির্ধারণের জন্য নদীর তীরে অবস্থানরত কৃষকের তাক্বলীদ করা উম্মাতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এটা খাঁটি তাক্বলীদ।

জবাব : ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, এটা তাক্বলীদের কোন দলীল নয়। কেননা তারা এর দ্বারা অন্যের সংবাদ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বীনের ব্যাপারে দলীল বিহীন কোন ফৎওয়া গ্রহণ করা হয়নি। আর এটা এমন কোন বিষয় নয়, যা দ্বারা কোন হালালকে হারাম করা হয়েছে, অথবা ফরয নয় এমন কোন বিষয়কে ফরয করা হয়েছে, অথবা কোন ফরযকে ত্যাগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দলীল হিসাবে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা তাক্বলীদ নয়; বরং সংবাদ মাত্র। আর অনেক ক্ষেত্রে খবরে ওয়াহেদ গ্রহণযোগ্য যা ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। যেমন কোন ঋতুবর্তী মহিলার হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার সংবাদ শুনে স্ত্রীমিলন বৈধ হয়ে থাকে। (আল-ইহকামফীউছুলিলআহকাম, পৃঃ৮০১।)

১৫তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন,  আমাদের নিজেদের রায় বা মতের চেয়ে ছাহাবীদের রায় বা মত উত্তম। (আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবাআতি, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, পৃঃ১১৮।) অতএব আমরা বলব, আমাদের নিজেদের রায় বা মতের চেয়ে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও অন্যান্য ইমামদের রায় বা মত উত্তম।

জবাব : ১- তাক্বলীদ পন্থীরা ইসবার পূর্বে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর কথাকে উপেক্ষা করে। কেননা তারা তাদের অনুসরণীয় ইমামদের রায় বা মতের চেয়ে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর রায় বা মতকে উত্তম মনে করেনা।
২- উল্লেখিত দলীল মূলতঃ তাক্বলীদের বৈধতা প্রমাণ করে না। তাছাড়া ছাহাবীগণ ব্যতীত অন্য কারো অনুসরণ করা ওয়াজিব নয়। তাঁরা সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হতে ইলম অর্জন করেছেন, কোন মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহর রাসূলের নিকটে অহি-র অবতরণ অবলোকন করেছেন, তাদের ভাষাতেই (আরবী) অহী নাযিল হয়েছে। কোন সমস্যায় সরাসরি আল্লাহর রাসূলের নিকট হতে সমাধান গ্রহণ করেছেন। তাদের পরে এমন কেউ এইম র্যাদায় পৌঁছতে পরেনি, যার তাক্বলীদ করা যেতে পারে।
৩- ছাহাবীদের কথা দলীল যা ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। (ইলামুল মুয়াক্কিঈন২/১৮৫-১৮৬।) পক্ষান্তরে অনুসরণীয় ইমামদের কথা দলীল নয়।

১৬তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, ছালাতের মধ্যে মুক্তাদী যেমন ইমামের তাক্বলীদ করে, ইসলামের বিধান মানার ক্ষেত্রে আমরা তেমন প্রসিদ্ধ চার ইমামের যে কোন এক জনের তাক্বলীদ করি।

জবাব :ছালাতের মধ্যে ইমামের অনুসরণ করা তাক্বলীদ নয়। বরং তাহল ইত্তেবা। কেননা তা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। অথচ অনুসরণীয় ইমামের তাক্বলীদ করার এমন কোন দলীল নেই।যেখানে বলা হয়েছে যে, তোমরা ইমাম আবু হানীফা অথবা ইমাম শাফেঈর তাক্বলীদ কর। (ইলামুল মুয়াক্কিঈন২/১৮২।)

১৭তম দলীল : তাক্বলীদ পন্থীরা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই অন্যান্য মানুষ ফৎওয়া প্রদান করতেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
আবু হুরায়রাহ ও যায়েদ ইবনু খালিদ জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে বলেন যে, এক বেদুঈন এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কিতাব মুতাবেক আমাদের মাঝে ফায়ছালা করে দিন। তখন তার প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে বলল, সে ঠিকই বলেছে, হ্যাঁ, আপনি আমাদের মাঝে কিতাবুল্লাহ মুতাবেক ফায়ছালা করুন। পরে বেদুঈন বলল, আমার ছেলে এ লোকের বাড়িতে মজুর ছিল। অতঃপর তার স্ত্রীর সঙ্গে সে যিনা করে। লোকেরা আমাকে বলল, তোমার ছেলের উপরে রজম (পাথরের আঘাতে হত্যা) ওয়াজিব হয়েছে। তখন আমার ছেলেকে একশ বকরী ও একটি বাঁদীর বিনিময়ে এর নিকট হতে মুক্ত করে এনেছি। পরে আমি আলিমদের নিকট জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বললেন, তোমার ছেলের উপর একশ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের নির্বাসন ওয়াজিব হয়েছে। সব শুনে নবী (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদের মাঝে কিতাবুল্লাহ মুতাবেকই ফায়ছালা করব। বাঁদী এবং বকরীর পাল তোমাকে ফেরত দেওয়া হবে, আর তোমার ছেলেকে একশ বেত্রাঘাতসহ একবছরের নির্বাসন দেওয়া হবে। আর অপর জনের ব্যাপারে বললেন, হে উনাইস! তুমি আগামীকাল সকালে এ লোকের স্ত্রীর নিকট যাবে এবং তাকে রজম করবে। উনাইস তার নিকট গেলেন এবং তাকে রজম করলেন। (বুখারী, অন্যায়ের উপর চুক্তিবদ্ধ হলে তা বাতিল অধ্যায়, হা/২৬৯৫-২৬৯৬, বাংলাঅনুবাদ, ৩/৬৬।) অতএব এ হাদীছ দ্বারা তাক্বলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়।

জবাব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় উল্লেখিত মাসআলার সমাধান দিতে গিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়।যেমন কতিপয় ছাহাবী অবিবাহিত যেনাকারকে রজম করার ফৎওয়া প্রদান করেছেন। আবার কতিপয় ছাহাবী তাকে একশ বেত্রাঘাত সহ এক বছরের নির্বাসন ওয়াজিব ফৎওয়া প্রদান করেছেন। আর কোন বিষয়ে এরূপমতভেদ দেখা দিলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যাওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মত বিরোধ কর, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর (নিসা৫৯)। অতএব উল্লেখিত মাসআলায় মতভেদ দেখা দিলে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তা প্রত্যার্পন করেছিলেন।আর রাসূল (ছাঃ) সঠিক ফায়ছালা প্রদান করেছিলেন। বর্তমানেও যদি কোন মাসআলায় আমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তাহলে ফিরে যেতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে। আর যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে যাওয়া হবে, তখন তাক্বলীদ দূরীভূত হবে। আমরা ওলামায়ে কেরামের ফৎওয়া প্রদানকে অস্বীকার করিনা। কিন্তু অস্বীকার করি দলীল বিহীন ফৎওয়া প্রদানকে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে না গিয়ে অনুসরণীয় মাযহাবের ইমামদের দিকে ফিরে যাওয়াকে। (আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ৮২৪-৮২৫।)
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন