শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

তিন রাক‘আত বিতর মাগরিবের ছালাতের ন্যায় পড়া

প্রশ্ন  : দিগন্ত টেলিভিশনে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, তিন রাকআত বিতর মাগরিবের ছালাতের ন্যায় পড়ারও ছহীহ হাদীছ আছে। সুতরাং এ নিয়ে ফেৎনা করা সমীচীন নয়। উক্ত বক্তব্য কি সঠিক?

উত্তর : উক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
তোমরা মাগরিবের ছালাতের ন্যায় (মাঝখানে বৈঠক করে) বিতর আদায় করো না (দারাকুৎনী হা/১৬৩৪-৩৫; ছহীহ ইবনে হিববান হা/২৪২০; তুহফাতুল আহওয়াযী ২য় খন্ড, পৃঃ ৪৫৩)। পক্ষান্তরে মাগরিবের ছালাতের ন্যায় বিতর পড়ার পক্ষে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (يَحْيَى بْنُ زَكَرِيَّا هَذَا يُقَالُ لَهُ ابْنُ أَبِى الْحَوَاجِبِ ضَعِيفٌ. وَلَمْ يَرْوِهِ عَنِ الأَعْمَشِ مَرْفُوعًا غَيْرُهُ). (দারাকুৎনী হা/১৬৩৭)

‘ডেসটিনি ২০০০ প্রাইভেট লিমিটেড’ যে কার্যক্রম চালাচ্ছে

প্রশ্ন : ডেসটিনি ২০০০ প্রাইভেট লিমিটেড যে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং Multi Level Marketingপদ্ধতিতে যে লভ্যাংশ মানুষকে দিচ্ছে তা কি শরীআত সম্মত?

উত্তরঃ মৌলিকভাবে দু
টি পদ্ধতিতে যৌথ ব্যবসা করা শরীআত সম্মত। একটির নাম মুশারাকাহ (مشاركة) অর্থাৎ শরীকানা ব্যবসা। এতে যার যেমন অর্থ থাকবে, সে তেমন লভ্যাংশ পাবে (আবুদাঊদ হা/৪৮৩৬; সনদ ছহীহ, বুলূগুল মারাম হা/৮৭০; নায়ল হা/২৩৩৪-৩৫)। অপরটির নাম মুযারাবাহ (مضاربة) অর্থাৎ একজনের অর্থ নিয়ে অপর জন ব্যবসা করবে। এ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ তাদের মাঝে চুক্তিহারে বন্টিত হবে (দারাকুৎনী হা/৩০৭৭; মুওয়াত্ত্বা হা/২৫৩৫; ইরওয়াউল গালীল হা/১৪৭২, ৫/২৯২ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৮৯৫, মওকূফ ছহীহ)। প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যবসা এ দুয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
 

সঊদী আরবের জাতীয় গবেষণা ও ফাতাওয়া বিভাগের স্থায়ী কমিটি (লাজনা দায়েমাহ) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে যে, পিরামিড স্কীম, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা এমএলএম যে নামেই হোক না কেন এ ধরনের সকল প্রকার লেনদেন নিষিদ্ধ। কেননা এর উদ্দেশ্য হল, কোম্পানীর জন্য নতুন নতুন সদস্য সৃষ্টির মাধ্যমে কমিশন লাভ করা, পণ্যটি বিক্রি করে লভ্যাংশ গ্রহণ করা নয়। এ কারবার থেকে বহুগুণ কমিশন লাভের প্রলোভন দেখানো হয়। স্বল্পমূল্যের একটি পণ্যের বিনিময়ে এরূপ অস্বাভাবিক লাভ যে কোন মানুষকে প্ররোচিত করবে। আর এতে ক্রেতা-পরিবেশকদের মাধ্যমে কোম্পানী এক বিরাট লাভের দেখা পাবে। মূলতঃ পণ্যটি হল কোম্পানীর কমিশন ও লাভের হাতিয়ার মাত্র।
 

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যবসা অসম মূল্য নির্ধারণ ও অতিরঞ্জিত আয়ের প্রলোভন দেখানোর কারণে অভিযুক্ত হয়েছে। আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশন (FTC) ২০০৮ সালের মার্চ মাসে তাদের প্রস্তাবিত ব্যবসায় সুযোগ সম্বন্ধীয় তালিকা থেকে এমএলএম কোম্পানীগুলোর নাম বাদ দিয়েছে। সংস্থাটি গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, নতুন সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে কমিশন গ্রহণ করার এই রীতি (এমএলএম) বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পিরামিড স্কীম পদ্ধতির ন্যায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে (দ্রঃ Multi-level marketing-উইকিপিডিয়া)। 


তত্ত্বগতভাবেও এ ধরনের মার্কেটিং বিষয়ে অনেক আপত্তি রয়েছে। কেননা এ মার্কেটিং-কে বলা হয়েছে, MLM is like a train with no brakes and no engineer headed full-throttle towards a terminal. অর্থাৎ সর্বোচ্চ গতিতে স্টেশনমুখী একটি ট্রেনের মত যার কোন ব্রেক নেই, নেই কোন চালক (দ্রঃ www.vandruff.com/mlm.html)।
 

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এ ব্যবসা সমর্থন করা যায় না। কেননা একজন গ্রাহককে তার আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের বশীভূত করে পণ্য বিক্রয় করতে বলা হয়। ফলে গ্রাহক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে সে ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থের কেন্দ্রে পরিণত করে। এ সম্পর্ক তখন হয়ে যায় যান্ত্রিক। নিষ্কলুষ বন্ধুত্বের স্থলে তখন সন্দেহ আর সংকীর্ণতাবোধ স্থান করে নেয়। নিজ গৃহ পরিণত হয় মার্কেট প্লেসে। যে কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন লোক এ কাজে ঘৃণাবোধ করবে।
 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট। এর মধ্যবর্তী বিষয়সমূহ অস্পষ্ট, যা অনেক মানুষ জানে না। অতএব যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ বস্তুসমূহ থেকে বেঁচে থাকবে, সে ব্যক্তি তার দ্বীন ও সম্মানকে পবিত্র রাখলো। আর যে ব্যক্তি সন্দিগ্ধ কাজে লিপ্ত হল, সে হারামে পতিত হ(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সন্দিগ্ধ বিষয় পরিহার করে নিঃসন্দেহ বিষয়ের দিকে ধাবিত হও। কেননা সত্যে রয়েছে প্রশান্তি এবং মিথ্যায় রয়েছে সন্দেহ (তিরমিযী হা/২৫৮১; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/২৭৭৩)
 

অতএব আমাদের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এই যে, প্রশ্নে উল্লেখিত নামে বা অন্য নামে প্রচলিত এম.এল.এম ব্যবসা সমূহ শরীআত সম্মত হবে না। জান্নাত পিয়াসী মুমিনকে এসব থেকে বেঁচে থাকতে হবে (বিস্তারিত দেখুনঃ আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ২০০৮ প্রশ্নোত্তর : ২/৮২ ডেসটিনি২০০০ ব্যবসা কি জায়েয?

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

ওমর (রাঃ) মেয়েদের মোহরানা নির্ধারণ করে দিলে জনৈক মহিলা

প্রশ্ন  : ওমর (রাঃ) মেয়েদের মোহরানা নির্ধারণ করে দিলে জনৈক মহিলা তার বিরোধিতা করেছিলেন মর্মে যে ঘটনা প্রচলিত আছে তার প্রমাণ জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর : বায়হাক্বী (৭/২৩৩ পৃঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছটি মুনক্বাতি
অর্থাৎ যঈফ। তবে একই হাদীছ যা আবুদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, সেটি হাসান। তবে সেখানে মহিলার আপত্তির কথা বর্ণিত হয়নি। উল্লেখ্য যে, মোহরানা বেশী করায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং উক্ত আয়াত দ্বারা মুবাহ প্রমাণিত হয়। তবে সেটা হবে বরের আর্থিক অবস্থার বিবেচনায়। মোহরানায় কোন বাড়াবাড়ি করা যাবে না। বরং সর্বদা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে (দ্রঃ তাফসীর কুরতুবী; নিসা ২০ ও ২১ আয়াত; বায়হাক্বী মোহরানা অধ্যায় ৭/২৩৩-৩৫)

শেয়ার ব্যবসা কি জায়েজ

প্রশ্ন  : বাজারে শেয়ার বেচাকেনা হয়। এর লাভ লটারীর মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে বণ্টন করা হয় অথবা একাউন্টে জমা হয়। এভাবে লটারীর মাধ্যমে বেচাকেনা করা যাবে কি?
 
উত্তর : বিভিন্ন কারণে শেয়ার বেচাকেনা জায়েয নয়। যেমন- 


(১) ক্রেতার অনেক সময় সম্যক জ্ঞান থাকে না কী বস্তুর শেয়ার তিনি ক্রয় করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছেন (আবুদাঊদ হা/৩৪৮৮)। 

(২) যে বস্তুর শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তা দেখা ও জানা-বুঝার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন ক্রয়-বিক্রয়কে ধোঁকা বলেছেন (মুসলিম হা/৩৮৮১; বুলূগুল মারাম হা/৭৮৪)। 

(৩) শেয়ার ব্যবসার পণ্য আয়ত্বে নিয়ে আসার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বস্তু ক্রয়ের পর তা নিজ মালিকানায় নিয়ে আসার পূর্বে বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম হা/৩৯১৬ ও ৩৯২৫; বুলূগুল মারাম হা/৭৮৫)। 

(৪) শেয়ার ব্যবসা একটি জুয়া মাত্র। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ মাল দেখে না। অথচ ঘণ্টায় ঘণ্টায় দর উঠা-নামা হয়। 

(৫) শেয়ার ব্যবসায় ফটকাবাজারীর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় কোম্পানী তার প্রকৃত তথ্য গোপন রাখে। কখনো লোকেরা কোম্পানীতে শেয়ার কিনে অধিক লাভ করে। কখনো কারখানা তৈরি না করেই তার শেয়ার বাজারে ছাড়া হয় এবং নতুন শেয়ারে অধিক লাভ মনে করে সেটিকে লোকেরা অধিক মূল্যে খরিদ করে। কোনরূপ ব্যবসা বা মালামাল ছাড়াই তারা এ লাভ করে থাকে। এছাড়াও নিত্যনতুন ছলচাতুরী শেয়ারবাজারে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। 

(৬) এতে সূদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ শেয়ার ব্যবসা ব্যাংক থেকে সূদের ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে। অতএব শেয়ার ব্যবসা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক (দ্রঃ আত-তাহরীক ডিসেম্বর ২০১০, প্রশ্নোত্তর : ২৫/১০৫)

বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা


আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা
 (শেষ কিস্তি)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাটির তৈরী না নূরের?
আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে মাটি থেকে, জিন জাতিকে আগুন থেকে এবং ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ মাটির তৈরী একথা পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও মানুষ ছিলেন এবং তিনিও মাটির তৈরী ছিলেন। এক্ষেত্রে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে অনেকে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নূরের সৃষ্টি, অথচ কুরআন-সুন্নাহ বলছে তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি। সাধারণভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পিতা-মাতা মাটির তৈরী সাধারণ মানুষ ছিলেন। তাদের উভয়ের মিলনের ফলে তিনি জন্ম লাভ করেছেন। মাটির মানুষ থেকে মাটির মানুষই সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মাটির মানুষ থেকে কি করে নূরের তৈরী মানুষের জন্ম হতে পারে?

রাসূল (ছাঃ) বিবাহ করেছিলেন, তাঁর সন্তান-সন্ততিও ছিল। তাঁরা সবাই মাটির মানুষ ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) খাবার খেতেন, সাধারণ মানুষের মতই জীবন-যাপন করতেন এবং তাঁর প্রয়োজন ছিল পেশাব-পায়খানার। অন্য সব মানুষের মত নবী করীম (ছাঃ) মৃত্যু বরণও করেছেন। সুতরাং কোন জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ রাসূল (ছাঃ)-কে নূরের সৃষ্টি বলতে পারে না। পূর্বযুগের কাফেররা নবী-রাসূলদেরকে মেনে নিতে চাইতো না; কারণ তাঁরা সবাই মাটির মানুষ ছিলেন। সকল নবী-রাসূলগণ যেমন মাটির মানুষ ছিলেন তেমনি নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও মাটির মানুষ ছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বিশদ বিবরণ উপস্থাপিত হয়েছে।
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার মূল উপাদান হতে (মুমিনূন ১২)

পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ যে মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন, এ মর্মে কুরআন থেকে দলীল :
(১) নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,  আর তার সম্প্রদায়ের প্রধানেরা যারা কাফের ছিল, তারা বলল, আমরা তো তোমাকে আমাদের মতই মানুষ ব্যতীত কিছু দেখছি না (হূদ ২৭)

(২) আল্লাহ বলেন,  তাদের রাসূলগণ বলেছিলেন, আল্লাহ সম্বন্ধে কি কোন সন্দেহ আছে, যিনি আকাশ সমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা? তিনি তোমাদেরকে আহবান করেন তোমাদের পাপ মার্জনা করার জন্য এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দিবার জন্য? তারা বলত, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ (ইবরাহীম ১০)

(৩) আল্লাহ বলেন, তাদের রাসূলগণ তাদেরকে বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মত মানুষ (ইবরাহীম ১১)

(৪) আল্লাহ বলেন,  যখন তাদের নিকট আসে পথ-নির্দেশ, তখন লোকদেরকে এই উক্তিই বিশ্বাস স্থাপন হতে বিরত রাখে, আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন? (বানী ইসরাঈল ৯৪)

(৫) আল্লাহ বলেন,   ‘যারা যালিম তারা গোপনে পরামর্শ করে, এতো তোমাদের মত একজন মানুষই (আম্বিয়া ৩)

(৬) নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,  ‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, এতো তোমাদের মত একজন মানুষ (মুমিনুন ২৪)

(৭) আল্লাহ বলেন, তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ, যারা কুফরী করেছিল ও আখিরাতের সাক্ষাৎকারকে অস্বীকার করেছিল এবং যাদেরকে আমি দিয়েছিলাম পার্থিব জীবনে প্রচুর ভোগ-সম্ভার, তারা বলেছিল, এতো তোমাদের মত একজন মানুষ, তোমরা যা আহার কর সেও তাই আহার করে এবং তোমরা যা পান কর সেও তাই পান করে। যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজন মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে (মুমিনূন ৩৩-৩৪)

(৮) মূসা এবং হারূণ (আঃ) সম্পর্কে ফেরাঊন ও তার কওম বলল,- তারা বলল, আমরা কি এমন দুব্যক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করব, যারা আমাদেরই মত এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে (মুমিনূন ৪৭)

(৯) ঈসা (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের অনুরূপ; তিনি তাঁকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করলেন (আলে ইমরান ৫৯)

মুহাম্মাদ (ছাঃ) মাটির তৈরী এ সম্পর্কে কুরআনের দলীল :
(১) আল্লাহ তাআলা বলেন,  বলুন, পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক! আমি তো শুধু একজন মানুষ, একজন রাসূল (বানী ইসরাঈল ৯৩)

(২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,  বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মাবূদ একজন। সুতরাং যে তাঁর প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তাঁর প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে (কাহফ ১১০)

(৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,  ‘বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি অহী হয় যে, তোমাদের মাবূদ একমাত্র (সত্য) মাবূদ (হা-মীম সিজদা ৬)

উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত নবী রাসূলগণ মাটির মানুষ ছিলেন। অনুরূপভাবে আমাদের নবীও মাটির মানুষ ছিলেন। মানুষের অভ্যাস ভুলে যাওয়া, অপারগ ও অসুস্থ হওয়া, ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগা, বিবাহ করা, সন্তান-সন্ততি হওয়া ইত্যাদি। এ সকল গুণ নবী-রাসূল সবার মাঝেই ছিল। তাঁদের সবার পিতা-মাতা ছিল, তাঁদের সবার স্ত্রী-পরিবার ছিল। তাঁরা খেতেন, পান করতেন, রোগ ও বালা-মুছীবতে পতিত হতেন। তাঁরা অনেক সময় ভুলেও যেতেন। এ সকল গুণ দ্বারা সহজেই বুঝা যায় যে, তাঁরা সবাই মাটির সৃষ্টি মানুষ ছিলেন, নূরের তৈরী ছিলেন না।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন, এ সম্পর্কে হাদীছের দলীল :
রাসূল (ছাঃ)-এর অনেক সময় ভুল-ত্রুটি হত। ছালাত আদায়ের সময় যখন তিনি ভুলে যেতেন, তখন বলতেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমি ভুলে যাই, যেমনভাবে তোমরা ভুলে যাও। সুতরাং আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।(বুখারী, হা/৪০১; মুসলিম, হা/১২৭৪।)

সকল ফেরেশতা নূর থেকে সৃষ্টি এবং আদম সন্তান সবাই পানি ও মাটি থেকে সৃষ্টি। আর জিন জাতি আগুন থেকে সৃষ্টি। যেমন হাদীছে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,  সকল ফেরেশতাদেরকে নূর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জিন জাতিকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদম জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই সমস্ত ছিফাত দ্বারা, যে ছিফাতে তোমাদের ভূষিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মানব জাতিকে মাটি ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। (মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭০১। )

এই হাদীছটি সমাজে বহুল প্রচলিত হাদীছকে বাতিল করে। তা হচ্ছে হে জাবের আল্লাহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন। অনুরূপ অন্য যে হাদীছগুলোতে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) নূরের তৈরী, সেগুলোও বাতিল। কারণ উপরোক্ত হাদীছটি প্রমাণ করে যে, সকল ফেরেশতা নূর থেকে সৃষ্ট; আদম সন্তান নয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন, এ সম্পর্কে মনীষীগণের অভিমত :
ইমাম ইবনে হাযম (রহঃ) বলেন, সমস্ত নবী এবং ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর বান্দা, তাঁরা সমস্ত মানুষের মতই সৃষ্ট মানব। সবার জন্ম হয়েছে নারী-পুরুষের সংমিশ্রণে। শুধুমাত্র আদম এবং ঈসা (আঃ) ব্যতীত। অবশ্য আদমকে আল্লাহ তাআলা মাটি থেকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, কোন নারী পুরুষের সংমিশ্রণ ছাড়া। আর ঈসা (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন তাঁর মায়ের পেট থেকে কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়া। ( ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা, ১/২৯। )

শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এ বিশ্বাসের উপর মৃত্যুবরণ করবে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাটির মানুষ নয় বা আদম সন্তান নয় অথবা বিশ্বাস করে যে, তিনি অদৃশ্যের খবর জানেন, এটা কুফরী এবং একে বড় কুফরী গণ্য করা হবে অর্থাৎ ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী কুফরী। (মাজমূ ফাতাওয়া ৫/৩১৯। )

কুরআন বলছে, সকল নবী-রাসূল মাটির তৈরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও বলেছেন, আমি তোমাদের মতই মানুষ। বিদ্বানগণ বলছেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাটির মানুষ, সকল নবী-রাসূল এবং সকল সাধারণ মানুষের মত। এর পরেও যদি কেউ মিথ্যা বানোয়াট হাদীছ উল্লেখ করে বলে, তিনি নূরের তৈরী, তাহলে সে হবে আক্বীদাভ্রষ্ট।

রাসূল সম্পর্কে জাল বা বানাওয়াট হাদীছ সমূহ
(১) জাবের (রাঃ) একদা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হউক। আপনি বলুন, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কোন বস্তু সৃষ্টি করেছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তরে বললেন, হে জাবের! আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম তাঁর নূর দ্বারা তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা সে নূরকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগ দ্বারা কলম, এক ভাগ দ্বারা লাওহে মাহফূয ও একভাগ দ্বারা আরশে আযীম সৃষ্টি করেছেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আসমান-যমীন ফেরেশতা, জিন প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। (মৌলভী মুহাম্মদ যাকির হুসাইন, মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৪১। )  এই হাদীছটি বাতিল, কোন হাদীছ গ্রন্থে হাদীছটি পাওয়া যায় না।

(২) লাওহে মাহফূয সৃষ্টির পর তাতে আল্লাহর নামের পার্শ্বে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম অর্থাৎ কালেমায় তাইয়িবাহ লিখে রাখা হয়। ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, জান্নাতে আদম (আঃ) যখন আল্লাহর একটি আদেশ লংঘন করে পরে নিজ ভুল বুঝতে পারলেন, তখন তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট এভাবে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ রাববুল আলামীন! আপনি আমাকে মুহাম্মাদের অসীলায় ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ পাক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আদম! তুমি মুহাম্মাদকে চিনলে কিভাবে, তাঁকে তো আমি এখন পর্যন্ত সৃষ্টি করিনি? তখন আদম (আঃ) বললেন, হে দয়াময় প্রভু! আমাকে সৃষ্টি করে যখন আপনি আমার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলেন, তখন আমি চক্ষু মেলে তাকিয়ে দেখলাম, আরশের গায়ে লেখা রয়েছে লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লা-হ। তখন আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই আপনি ঐ ব্যক্তির নাম আপনার নিজের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন, যিনি আপনার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম! তুমি ঠিকই বলেছ। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ সৃষ্টি জগতের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। এমনকি তাঁকে সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না। (মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৪১। )

ইমাম ত্বহাবী বলেন, হাদীছটি আহলুল ইলমের নিকট নিতান্ত দুর্বল। ( তাহযীবুত তাহযীব ২/৫০৮ পৃঃ। ) আবূদাঊদ, আবূ যুরআ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম দারা-কুত্বনী এবং ইবনে হাজার আস-ক্বালানী সবাই বলেন, হাদীছটি দুর্বল।(ইমাম নাসাঈ, কিতাবুয যুআফা ওয়াল মাতরূকীন, পৃঃ ১৫৮, হা/৩৭৭। )

ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, হাদীছটি যে দুর্বল এ ব্যাপারে সবাই একমত। নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদীছটি বানাওয়াট।(সিলসিলা যঈফা হা/২৫। ) ইমাম আলুসী হানাফী বলেন, হাদীছটির কোন ভিত্তিই নেই।(গায়াতুল আমানী ১/৩৭৩)

(৩) হাদীছে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় প্রিয়তম নবী (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম, তবে নিশ্চয়ই এ কুল-মাখলূক সৃষ্টি করতাম না।(মুকামমাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৪০। ) হাদীছটি বানাওয়াট, বাতিল।

(৪) হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আপনি না হলে আসমান-যমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। ( আবুল হাসান আল-কাত্তানী, তানযীহুশ শরীআত আন আহাদীছিশ শীআ, ১/৩২৫। ) ইবনু জাওযী বলেন, হাদীছটি যে বানাওয়াট এতে কোন সন্দেহ নেই। ইমাম দারা-কুত্বনী বলেন, হাদীছটি দুর্বল। ফালাস বলেন, হাদীছটি বানাওয়াট।(ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূআত, ২/১৯। )

(৫) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,  অর্থাৎ আল্লাহ রাববুল আলামীন সর্বপ্রথম আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন। (মুকাম্মাল মীলাদে মুস্তফা (সঃ), পৃঃ ৭৭। ) এটা হাদীছ নয়; বরং ছূফীদের বানাওয়াট কথা।

(৬) হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আপনি না হলে আসমান-যমীন, আরশ-কুরশী, চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদি কিছুই সৃষ্টি করা হত না। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, এটি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ নয়। এটি কোন বিদ্বান তাঁদের হাদীছ গ্রন্থে হাদীছে রাসূল বলে উল্লেখ করেননি এবং ছাহাবায়ে কেরাম থেকেও বর্ণিত হয়নি। বরং এটি এমন একটি কথা, যার বক্তা জানা যায় না। (মাজমূ ফাতাওয়া ১১/৯৬। )

(৭) আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় নক্ষত্র রূপে মুহাম্মাদের নূর অবলোকন করে মুগ্ধ হন।

(৮) মিরাজের সময় আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতা সহ আরশে আরোহন করতে বলেন, যাতে আরশের গৌরব বৃদ্ধি পায় (নাঊযুবিল্লাহ)

(৯) রাসূলের জন্মের খবরে খুশি হয়ে আঙ্গুল উঁচু করার কারণে ও সংবাদ দানকারিণী দাসী ছুওয়াবাকে মুক্তি দেয়ার কারণে জাহান্নামে আবু লাহাবের হাতের দুটি আঙ্গুল পুড়বে না। এছাড়াও প্রতি সোমবার রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম দিবসে জাহান্নামে আবু লাহাবের শাস্তি মওকূফ করা হবে বলে আববাস (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দেখা একটি স্বপ্নের বর্ণনা তাঁর নামে সমাজে প্রচলিত আছে, যা ভিত্তিহীন।

(১০) মা আমেনার প্রসবকালে জান্নাত হতে বিবি মরিয়াম, বিবি আসিয়া ও মা হাজেরা দুনিয়ায় নেমে এসে সবার অলক্ষ্যে ধাত্রীর কাজ করেন।

(১১) নবীর জন্ম মুহূর্তে কাবার প্রতিমাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, রোমের অগ্নি উপাসকদের শিখা অনির্বাণগুলো দপ করে নিভে যায়। বাতাসের গতি, নদীর প্রবাহ, সুর্যের আলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি...। ( মৌলুদে দিল পছন্দ, মৌলুদে ছাদী, আল-ইনছাফ, মিলাদ মাহফিল প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। ) উপরের বিষয়গুলো সবই বানাওয়াট ও ভিত্তিহীন।( বিস্তারিদ দ্রঃ মাওযুআতে কবীর প্রভৃতি; ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মীলাদ প্রসঙ্গ, পৃঃ ১২।)

পরিশেষে বলব, আল্লাহ ও রাসূল সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক সঠিক আক্বীদা পোষণ করতে হবে। তাঁদের প্রতি যথাযথ ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মুমিন হওয়া যাবে। ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণ করে যেমন মুমিন হওয়া যাবে না, তেমনি পরকালে নাজাতও মিলবে না। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন-আমীন!