শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১২

আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ


আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ
 (২য় কিস্তি)
কারণ ৩ : ভিন্নমত পোষণকারীর নিকট হাদীছ পৌঁছেছে, কিন্তু সে ভুলে গেছে :
অনেক মানুষ আছে কখনও ভোলে না। কত মানুষ আছে  হাদীছ ভুলে যায়। এমনকি কখনও আয়াতও ভুলে যায়। রাসূল (ছাঃ) একদিন ছাহাবীগণকে নিয়ে ছালাত আদায় করছিলেন এবং তিনি ভুলক্রমে একটি আয়াত ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন উবাই ইবনু কাব (রাঃ)। ছালাত শেষে রাসূল (ছাঃ) বললেন,  তুমি কি আমাকে আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দিতে পারনি!’(আবূদাঊদ হা/৯০৭, ছালাত অধ্যায়। )  অথচ তিনি সেই ব্যক্তি, যার উপর অহী নাযিল হয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করেই আল্লাহ পাক বলেছেন,  অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাবো, ফলে তুমি ভুলবে না। তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি প্রকাশ্য ও গুপ্ত বিষয় পরিজ্ঞাত আছেন (আলা ৬-৭)

এ ব্যাপারে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ)-এর সাথে ওমর (রাঃ)-এর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। রাসূল (ছাঃ) তাঁদের দুজনকে কোন এক প্রয়োজনে পাঠালে তাঁরা উভয়েই নাপাক হয়ে যান। আম্মার (রাঃ) ইজতেহাদ করেন, মাটি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন বোধ হয় পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের ন্যায়। তাই তিনি মাটিতে গড়াগড়ি করতে লাগলেন, যেমনিভাবে পশু গড়াগড়ি দেয়। এরপর তিনি ছালাত আদায় করেন। অপরদিকে ওমর (রাঃ) ছালাতই আদায় করলেন না। অতঃপর তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে তিনি তাঁদেরকে সঠিক নিয়ম বলে দেন। আম্মার (রাঃ)-কে তিনি বলেন, দুই হাত দিয়ে এরকম করলেই তোমার জন্য যথেষ্ট হত। (একথা বলে) তিনি তাঁর দুই হাত একবার মাটিতে মারলেন। অতঃপর বাম হাতকে ডান হাতের উপর বুলিয়ে উভয় হাতের তালু এবং মুখমন্ডল মাসাহ করলেন।

আম্মার (রাঃ) ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে এ হাদীছটি বর্ণনা করেন। এমনকি তার আগেও এটি বর্ণনা করতেন। ইতিমধ্যে ওমর (রাঃ) তাঁকে একদিন ডেকে পাঠান এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি এটি কি ধরনের হাদীছ বর্ণনা করছ? তখন আম্মার (রাঃ) বলেন, আপনার কি মনে পড়ে, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে কোন এক প্রয়োজনে পাঠালে আমরা নাপাক হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে আপনি ছালাত আদায় করলেন না। কিন্তু আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছিলাম। এরপর রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, দুই হাত দিয়ে এরকম করলেই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ওমর (রাঃ) ঘটনাটি স্মরণ করতে পারলেন না। তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় কর হে আম্মার! অতঃপর আম্মার (রাঃ) তাঁকে বললেন, আল্লাহ কর্তৃক আমার উপর আপনার অনুসরণ যেহেতু আবশ্যক, সেহেতু আপনি নিষেধ করলে হাদীছটি আমি আর বর্ণনা করব না। তখন ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, আমাকে যে দায়িত্ব অর্পণ করছ, তোমাকেও সে দায়িত্ব অর্পণ করলাম।( বুখারী হা/৩৩৮, ৩৪৫-৪৬, তায়াম্মুম অধ্যায়; মুসলিম হা/৩৬৮, হায়েয অধ্যায়। ) অর্থাৎ তুমি এই হাদীছ মানুষের কাছে বর্ণনা কর। দেখা গেল, সাধারণ অযূর ক্ষেত্রে যে তায়াম্মুম রাসূল (ছাঃ) নির্ধারণ করেছেন, ঠিক ঐ একই তায়াম্মুম বীর্যস্খলন জনিত কারণে অপবিত্র অবস্থায়ও নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু একথাটি ওমর (রাঃ) ভুলে গেছেন। তিনি এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-এর পক্ষেই ছিলেন। আর আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) ও আবু মূসা (রাঃ)-এর মাঝে এ বিষয়ে বিতর্কও হয়েছে। বিতর্কে আবু মূসা (রাঃ) ওমর (রাঃ)-এর উদ্দেশ্যে বলা আম্মার (রাঃ)-এর উক্তিটি পেশ করেন। তখন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, তুমি কি দেখনি যে, ওমর (রাঃ) আম্মার (রাঃ)-এর কথায় পরিতুষ্ট হতে  পারেননি? অতঃপর আবু মূসা (রাঃ) বলেন, ঠিক আছে আম্মার (রাঃ)-এর কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু এই আয়াত সম্পর্কে তুমি কি বলবে? অর্থাৎ সূরা মায়েদার আয়াত। জবাবে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কিছুই বললেন না। অথচ নিঃসন্দেহে এখানে অধিকাংশ বিদ্বানের কথাই সঠিক, তারা বলছেন, বীর্যপাত জনিত কারণে অপবিত্র ব্যক্তি তায়াম্মুম করবে, যেমনিভাবে ছোট নাপাকীর কারণে অপবিত্র ব্যক্তি তায়াম্মুম করে থাকে।

এ ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ কখনও ভুলে যেতে পারে; এতে শারঈ কোন হুকুম তার কাছে অজানা থেকে যেতে পারে। ফলে সে যদি ভুলে কিছু বলে, তাহলে ওযরগ্রস্ত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি দলীল জানবে, সে তো ওযরগ্রস্ত হিসাবে পরিগণিত হবে না।

কারণ ৪ : ভিন্নমত পোষণকারীর নিকট হাদীছ পৌঁছেছে, কিন্তু সে হাদীছের উদ্দেশ্যের বিপরীত অর্থ বুঝেছে :
এ ব্যাপারে আমরা দুটি উদাহরণ পেশ করব। একটি কুরআন থেকে এবং অপরটি হাদীছ থেকে।
১. কুরআন থেকে : মহান আল্লাহর বাণী, তোমরা যদি রোগগ্রস্ত হও কিংবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও (মায়েদা ৬)
বিদ্বানগণ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর আয়াতাংশের অর্থ বুঝতে গিয়ে মতভেদ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ বুঝেছেন, স্বাভাবিক স্পর্শ। অন্যরা বুঝেছেন, যৌন উত্তেজনার সাথে স্পর্শ। আবার কেউ কেউ বুঝেছেন, সহবাস। শেষোক্তটি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর অভিমত।

এখন আপনি যদি আয়াতটি নিয়ে ভালভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন যে, যাঁরা আয়াতাংশের অর্থ করেছেন সহবাস তাঁদের কথাই ঠিক। কেননা মহান আল্লাহ পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে দুই প্রকার পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন। একটি ছোট অপবিত্রতা (الحدث الأصغر) তে পবিত্রতা অর্জন এবং অপরটি (الحدث الأكبر)  বড় অপবিত্রতা হতে পবিত্রতা অর্জন। ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বলেন,  তোমাদের মুখমন্ডল ধৌত কর এবং হাতগুলিকে কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও। আর মাথা মাসাহ কর এবং পাগুলিকে গোড়ালি পর্যন্ত ধুয়ে ফেল (মায়েদা ৬)

আর বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি বলেন,  আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তাহলে বিশেষভাবে পবিত্র হবে(মায়েদা ৬)

এক্ষণে বালাগাত ও ফাছাহাতের দাবী হচ্ছে, তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রেও দুই প্রকার পবিত্রতার কথা উল্লেখ করা। অতএব মহান আল্লাহর বাণী, অথবা তোমাদের কেউ যদি পায়খানা থেকে আসে দ্বারা ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ  ‘কিংবা তোমরা স্ত্রীদেরকে স্পর্শ কর দ্বারা বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে আমরা যদি স্পর্শ (الملامسة) -কে [সহবাস অর্থে না নিয়ে] স্বাভাবিক স্পর্শ অর্থে নেই, তাহলে দেখা যায়, উক্ত আয়াতে ছোট অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের কারণ সমূহের দুটি কারণ উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন কিছুরই উল্লেখ নেই। আর এটি পবিত্র কুরআনের বালাগাতের পরিপন্থী। সুতরাং যারা আয়াতাংশের অর্থ সাধারণ স্পর্শ বুঝেছেন, তারা বলেছেন, কোন পুরুষ যদি স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করে, তাহলে তার অযূ ভেঙ্গে যাবে। অথবা যদি সে যৌন কামনা নিয়ে স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করে, তাহলে অযূ ভাঙবে। আর যৌন কামনা ছাড়া স্পর্শ করলে অযূ ভাঙবে না। অথচ সঠিক কথা হল, উভয় অবস্থাতেই অযু ভাঙবে না। কেননা হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) তাঁর কোন এক স্ত্রীকে চুম্বন করলেন, অতঃপর ছালাত পড়তে গেলেন, অথচ অযূ করলেন না। (আবূদাঊদ হা/১৭৮-৭৯, পবিত্রতা অধ্যায়; তিরমিযী হা/৮৬; ইবনু মাজাহ হা/৫০২-৫০৩।) আর এই বর্ণনাটি কয়েকটি সূত্রে এসেছে, যার একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে।

২. হাদীছ থেকে : রাসূল (ছাঃ) যখন আহ্‌যাবের যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে যুদ্ধাস্ত্র খুলে রাখলেন, তখন জিবরীল (আঃ) এসে তাঁকে বললেন, আমরা অস্ত্র ছাড়িনি। সুতরাং আপনি বনী ক্বোরায়যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীগণকে বেরিয়ে পড়ার আদেশ দিলেন এবং বললেন, তোমাদের কেউ যেন বনী ক্বোরায়যার নিকট পৌঁছা ছাড়া আছরের ছালাত না পড়ে। দেখা গেল, ছাহাবীগণ এই হাদীছটি বুঝার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। তাঁদের কেউ কেউ বুঝলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর উদ্দেশ্য হল, বনী ক্বোরায়যার উদ্দেশ্যে দ্রুত রওয়ানা করা, যাতে আছরের সময় হওয়ার আগেই তাঁরা বনী ক্বোরায়যাতে পৌঁছে যান। সেজন্য তাঁরা রাস্তায় থাকা অবস্থায় যখন আছরের ছালাতের সময় হল, তখন ছালাত আদায় করে নিলেন এবং ছালাতের শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত ছালাতকে বিলম্বিত করলেন না। আবার তাঁদের অনেকেই বুঝলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর উদ্দেশ্য হল, তাঁরা যেন বনী ক্বোরায়যায় পৌঁছার পূর্বে ছালাত আদায় না করে। সেজন্য তাঁরা ছালাতকে বনী ক্বোরায়যাতে পৌঁছার সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করলেন; এমনকি ছালাতের ওয়াক্তও শেষ হয়ে গেল। (বুখারী হা/৯৪৬ ভয়-ভীতি অধ্যায়; মুসলিম হা/১৭৭০।)

নিঃসন্দেহে যাঁরা সঠিক সময়ে ছালাত আদায় করেছেন, তাঁদের বুঝই ছিল সঠিক। কেননা সময়মত ছালাত ওয়াজিব হওয়ার উদ্ধৃতিগুলি মুহকাম (محكمة) বা সুস্পষ্ট পক্ষান্তরে এই উদ্ধৃতিটি হচ্ছে মুতাশাবিহ (مةشابهة) বা অস্পষ্ট আর নিয়ম হচ্ছে, মুহকাম মুতাশাবিহ-এর উপর প্রাধান্য পাবে। অতএব বুঝা গেল, কোন দলীলকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর উদ্দেশ্যের উল্টা বুঝা মতানৈক্যের অন্যতম একটি কারণ।

কারণ ৫ : ভিন্নমত পোষণকারীর নিকটে হাদীছ পৌঁছেছে। কিন্তু হাদীছটি রহিত এবং সে রহিতকরণ সম্পর্কে জানে না :
হাদীছটি ছহীহ এবং তার অর্থ ও তাৎপর্যও বোধগম্য। কিন্তু তা রহিত। আর উক্ত আলেম যেহেতু হাদীছটি রহিত হওয়ার বিষয়ে জানেন না, সেহেতু সেটি তার জন্য ওযর হিসাবে গণ্য হবে। কেননা [শারঈ বিধানের ক্ষেত্রে] আসল ল, রহিত হওয়ার ইলম না থাকলে, রহিত না হওয়া।

এ কারণে মুছল্লী রুকূতে গিয়ে কিভাবে তার হস্তদ্বয় রাখবে, সে বিষয়ে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ভিন্নমত পোষণ করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুছল্লীর জন্য বৈধ ছিল (রুকূতে) দুই হাত একত্রে করে দুই হাঁটুর মাঝখানে রাখা। কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায় এবং দুই হাত দুই হাঁটুর উপরে রাখার বিধান চালু হয়। ছহীহ বুখারীসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে রহিত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। (বুখারী হা/৭৯০, আযান অধ্যায়। ) কিন্তু ইবনু মাসঊদ (রাঃ) রহিত হওয়ার বিষয়টি জানতেন না। ফলে তিনি দুই হাত একত্র করে দুই হাঁটুর মাঝখানেই রাখতেন। [একদিন] তাঁর পাশে আলক্বামা ও আল-আসওয়াদ (রাঃ) ছালাত পড়লে এবং তাঁরা তাঁদের দুই হাত দুই হাঁটুর উপর রাখলেন। কিন্তু ইবনু মাসঊদ (রাঃ) তাঁদেরকে অনুরূপ করতে নিষেধ করলেন এবং দুই হাতকে একত্রিত করে দুই হাঁটুর মাঝখানে রাখার আদেশ করলেন।( মুসলিম হা/৫৩৪ মসজিদ সমূহ অধ্যায়।) কারণ তিনি রহিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেননি। আর মানুষের উপর তার সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপানো হয়নি। মহান আল্লাহ বলেন, لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً إِلاَّ وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ- আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। সে তাই পায়, যা সে উপার্জন করে। আর তাই তার উপর বর্তায়, যা সে করে (বাক্বারাহ ২৮৬)

কারণ ৬ : ভিন্নমত পোষণকারীর নিকট দলীল পৌঁছলেও তাকে তার চেয়ে শক্তিশালী দলীল বা ইজমা-এর বিরোধী মনে করা :
দলীল পেশকারীর কাছে দলীল পৌঁছেছে; কিন্তু তাঁর মতে, উক্ত দলীল তার চেয়ে শক্তিশালী দলীল বা ইজমা-এর বিরোধী। আর আলেমগণের মতানৈক্যের ক্ষেত্রে এই কারণটিই অনেক বেশী। সেজন্য আমরা কোন কোন আলেমকে ইজমার উদ্ধৃতি অধিক দিতে শুনি। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তা ইজমা নয়।
ইজমার উদ্ধৃতি পেশের ক্ষেত্রে একটি অদ্ভূত উদাহরণ হচ্ছে- কেউ কেউ বলেন, দাসের সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরাম একমত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, দাসের সাক্ষ্য গ্রহণীয় নয় মর্মে তারা একমত হয়েছেন। এটি অদ্ভূত একটি বর্ণনা! কেননা কেউ কেউ যখন তাঁর আশেপাশের সবাইকে কোন বিষয়ে একমত হতে দেখেন, তখন সেই বিষয়টি উদ্ধৃতি সমূহের [কুরআন-হাদীছের উদ্ধৃতি] অনুকূলে ভাবেন এবং মনে করেন, তাঁদের বিরোধী কোন দলীল নেই। সেজন্য তাঁর ব্রেইনে দুই ধরনের দলীলের সমাবেশ ঘটে-  উদ্ধৃতি ও ইজমা। কখনও তিনি মনে করেন, ঐ বিষয়টি সঠিক কিয়াস এবং দৃষ্টিভঙ্গিরও অনুকূলে। ফলে তিনি ঐ বিষয়ে মতানৈক্য না থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং সঠিক ক্বিয়াসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উদ্ধৃতির বিরোধী কোন দলীল আছে বলে তিনি মনে করেন না। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি ছিল উল্টা।

আমরা রিবাল ফায্ল (رِبَا الْفَضْلِ) -এর ক্ষেত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর অভিমতটিকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করতে পারি -
রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الرِّبَا فِيْ النَّسِيَّةِ সূদ শুধুমাত্র রিবান-নাসিইয়াহ-এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।(বুখারী হা/২১৭৮-৭৯,ব্যবসা-বাণিজ্য অধ্যায়; মুসলিম হা/১৫৯৬; ইবনু মাজাহ হা/১৫৮৭ ব্যবসা-বাণিজ্য অধ্যায়।) উবাদাহ ইবনু ছামেত (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীছে প্রমাণিত হয়েছে, রিবান-নাসিইয়াহ এবং রিবাল ফায্ল উভয় ক্ষেত্রেই সূদ হবে।(মুসলিম হা/১৫৮৭।)

ইবনু আববাস (রাঃ)-এর পরে সকল আলেম একমত হয়েছেন যে, সূদ দুই প্রকার- (১) রিবাল ফায্ল (ربا الفضل)  ও (২) রিবান নাসিইয়াহ (ربا النسيئة) । কিন্তু ইবনু আববাস (রাঃ) নাসিইয়াহ ব্যতীত অন্য কিছুতে সূদ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। যেমন যদি আপনি হাতে হাতে এক ছা গম দুই ছা গমের বিনিময়ে বিক্রয় করেন, তাহলে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকটে কোন সমস্যাই নেই। কেননা তাঁর মতে, সূদ কেবলমাত্র নাসিইয়াহ-এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।

অনুরূপভাবে যদি তুমি দুই মিছক্বাল [সোনার ওযন বিশেষ] সোনার বিনিময়ে এক মিছক্বাল সোনা হাতে হাতে বিক্রয় কর, তাহলে তাঁর নিকটে সূদ হবে না। তবে যদি গ্রহণ করতে দেরী কর অর্থাৎ তুমি আমাকে যদি এক মিছক্বাল সোনা দাও কিন্তু আমি তার মূল্য যদি তোমাকে এখন না দিয়ে উভয়ে বেচাকেনার বৈঠক থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে দেই, তাহলে সেটি সূদ হবে। কেননা ইবনু আববাস (রাঃ)-এর মতে, হাদীছে উল্লেখিত এই সীমাবদ্ধতা নাসীয়াহ ছাড়া অন্য কিছুতে সূদ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আর আসলেই (إنما) শব্দটি সীমাবদ্ধতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং তা [নাসিইয়াহ] ছাড়া অন্য কিছুতে সূদ হবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উবাদাহ (রাঃ)-এর হাদীছ প্রমাণ করে যে, রিবাল ফাযলও সূদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ زَادَ أَوْ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى، যে ব্যক্তি বেশী দিল বা নিল, সে সূদী কারবার করল।(মুসলিম হা/১৫৮৮।)

এক্ষণে ইবনু আববাস (রাঃ) কর্তৃক দলীল হিসাবে পেশকৃত হাদীছের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কি হবে?
আমাদের ভূমিকা হবে, হাদীছটিকে আমরা এমন অর্থে গ্রহণ করব, যাতে রিবাল ফায্ল-কে সূদ গণ্যকারী হাদীছের সাথে এই হাদীছও মিলে যায়। সেজন্য আমরা বলব, মারাত্মক সূদ হচ্ছে, রিবান নাসিইয়াহ, যার কারবার জাহেলী যুগের লোকেরা করত এবং যে সম্পর্কে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَأْكُلُوْا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ খেও না (আলে ইমরান ১৩০)। এটা হল রিবান-নাসিইয়াহ। তবে রিবাল ফাযল তদ্রূপ মারাত্মক নয়। সেকারণে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) তাঁর জগদ্বিখ্যাত লামুল মুওয়াক্কেঈন গ্রন্থে বলেন, মূল সূদের অন্যতম মাধ্যম হওয়ার কারণে রিবাল ফায্ল-কে হারাম করা হয়েছে। সেটিই যে মূল সূদ, সে হিসাবে নয়।
[চলবে]

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

চোর তওবা করার পূর্বে মারা গেলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কি?

প্রশ্ন  : চোর তওবা করার পূর্বে মারা গেলে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে কি?
 
উত্তর : চুরি করা কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই কেউ চুরি করার পর তওবা না করে মারা গেলে সে চুরির অপরাধে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করবে। তবে সে যদি আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে কালেমা পড়ে থাকে, তাহ
লে কালেমায়ে শাহাদাতের বরকতে এবং শেষনবী মুহম্মাদ (ছাঃ)-এর শাফাআতে এক সময় জান্নাতে ফিরে আসবে (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭৩)

মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্মদিনের স্মরণে কোন প্রাণী যবেহ

প্রশ্নঃ  : নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্মদিনের স্মরণে কোন প্রাণী যবেহ করলে তার গোশত খাওয়া যাবে কি?
 
উত্তর : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মদিনের স্মরণে কোন প্রাণী যবেহ করা জায়েয নয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে কোন কিছু উৎসর্গ করা শিরক। সুতরাং উক্ত প্রাণীর গোশত খাওয়া যাবে না (মায়েদাহ ৩)। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম দিন উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্নবী কিংবা সীরাতুন্নবী ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা বিদ
আত বা গর্হিত অন্যায় (মুসলিম হা/২০৪২; নাসাঈ হা/১৫৭৮; মিশকাত হা/১৪১)

সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১২

‘দুই পূর্ব এবং দুই পশ্চিমের রব’

প্রশ্ন  : সূরা রহমানে আল্লাহ বলেন, দুই পূর্ব এবং দুই পশ্চিমের রব। আমরা জানি, পূর্ব এবং পশ্চিম একটি করে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে উক্ত শব্দদ্বয় বহুবচনেও এসেছে। যেমন
রাববুল মাশারিক্ব অনেক পূর্বের রব (ছাফফাত ৫; মাআরিজ ৪০)। তাতে বুঝানো হয়েছে যে, সূর্য বছরের ৩৬০ দিনে নির্ধারিত একটি মাত্র স্থান হতে উদিত হয় না। এর দ্বারা সূর্যের গতিশীলতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা সৌর বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সূর্য প্রতিদিন পরিবর্তিত স্থান হতে উদিত হয়। সূরা রহমানে যে দ্বিবচন ব্যবহার করা হয়েছে তার দ্বারা সূর্য গ্রীষ্মকালে উত্তর-পূর্ব এবং শীতকালে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে উদয়াস্তের কথা বুঝানো হয়েছে (তাফসীরে ফাৎহুল ক্বাদীর, সূরা ছাফফাত ৫)