সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১১

জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত – ৯


জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত

(৪) মসজিদের পাশে মৃত ব্যক্তির কবর দেওয়া :
মৃত ব্যক্তি মুয়াযযিনের আযান ও ইমামের ক্বিরাআত শুনতে পায় এমন ধারণা করে সাধারণত এটা করা হয়। অনেকে এ জন্য অছিয়তও করে যান। অথচ এগুলো ভ্রান্ত আক্বীদা মাত্র। এভাবে অনেক মসজিদকে কবরস্থানে পরিণত করা হয়েছে। মূলতঃ মসজিদের জন্য ওয়াকফকৃত জমিতে কবর দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। না জেনে কবর দেওয়া হলে সেই কবরকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। (ছহীহ বুখারী হা/১৩৫১,
জানাযা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭ ও হা/৪২৮।)

আর যদি সেই কবর বহু পুরাতন হয় তাহলে মাটির সাথে সমান করে দিতে হবে এবং ঐ জায়গা সাধারণ জায়গার মত ব্যবহার করতে হবে। (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৩০১ পৃঃ; তালখীছু আহকামিল জানাইয, পৃঃ ৯১।) অন্যথা সেখানে ছালাত হবে না। এছাড়া মসজিদের পার্শ্বে পৃথক জমিতে কবর থাকলে অবশ্যই প্রাচীর দিয়ে মসজিদকে আলাদা করে নিতে হবে। মূলকথা মসজিদকে কবরের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে হবে।


(৫) মসজিদের দেওয়ালে আল্লাহমুহাম্মাদ লেখা, কাবা ও মসজিদে নববীর নকশা আঁকা বা ছবি স্থাপন করা কিংবা চাঁদ, তারা ও যোগ চিহ্ন সহ বিভিন্ন রকমের নকশা করা : 
আল্লাহু মুহাম্মাদ লেখা প্রায় মসজিদে দেখা যায়। এটা শিরকী আক্বীদার কারণে সমাজে চালু আছে। এর দ্বারা আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সমমর্যাদার অধিকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পথভ্রষ্ট পীর-ফকীরদের আক্বীদা হল,
আহাদ হয়ে যিনি আরশে ছিলেন তিনিই আহমাদ হয়ে মদীনায় অবতরণ করেন। কারণ যিনি আহমাদ তিনিই আহাদ। শুধু মাঝের মীমের পার্থক্য (নাঊযুবিল্লাহ)। তাছাড়া আরবীতে আল্লাহ মুহাম্মাদ লিখলে অর্থ হয়- আল্লাহই মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদই আল্লাহ। যা পরিষ্কার শিরক। অতএব এ সমস্ত বাক্য লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে। বহু মসজিদের চারপাশে আল্লাহর ৯৯ নাম লেখা আছে, কোন মসজিদে আয়াতুল কুরসী, সূরা ইয়াসীন ইত্যাদি লেখা থাকে। এগুলো সবই বাড়াবাড়ি এবং লৌকিকতার শামিল।

ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না যেমন খ্রীস্টানরা ঈসা ইবনু মারইয়ামকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। আমি কেবল তাঁর বান্দা। সুতরাং তোমরা বলো, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/৩৪৪৫, নবীদের ঘটনাবলী অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮; মিশকাত হা/৪৮৯৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৬৮০, ৯/১০৭ পৃঃ।)

কাবা কিংবা মসজিদে নববীর নকশা আঁকা বা ছবি স্থাপন করা কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কাজ। মুছল্লী সিজদা করে আল্লাহকে কাবা ঘরের পাথরকে নয়। কাবা শুধু মুসলিমদের ক্বিবলা। পূর্বের অনেক মসজিদে বিভিন্ন প্রাণীরও নকশা দেখা যায়। এগুলো ছালাতের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এমন সব ক্যালেন্ডার ঝুলানো হচ্ছে যেখানে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে মাছ বা কোন জীবের ক্যলিগ্রাফী তৈরি করা হয়েছে। যা মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। এগুলো সবই ছালাতের একাগ্রতা বিনষ্ট করে।

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদা একটি চাদরে ছালাত আদায় করেন যাতে নকশা ছিল। তিনি উক্ত নকশার দিকে একবার দৃষ্টি দেন। যখন তিনি ছালাত শেষ করলেন তখন বললেন, তোমরা আমার এই চাদরটি আবু জাহামের নিকট নিয়ে যাও এবং আম্বেজানিয়াহ কাপড়টি নিয়ে এসো। কারণ এটা এখনই আমাকে আমার ছালাত থেকে বিরত রেখেছিল। অন্য বর্ণনায় এসেছে,
 
আমি ছালাত অবস্থায় এর নকশার দিকে থাকাচ্ছিলাম। ফলে আশংকা করছিলাম আমাকে উহা ফেৎনার মধ্যে ফেলে দিবে।(ছহীহ বুখারী হা/৩৭৩, ছালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪; ছহীহ মুসলিম হা/১২৬৭; মিশকাত হা/৭৫৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭০১, ২/২৩৮, সতর ঢাকা অনুচ্ছেদ।)
অন্য হাদীছে এসেছে,
 
আনাস (রাঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ)-এর একটি পর্দা ছিল। তিনি সেটা দ্বারা  তার ঘরের এক পার্শ্ব ঢেকে রেখেছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) তাকে বলেন, আমার সামনে থেকে তোমার এই পর্দাটি সরিয়ে নাও। কারণ আমার ছালাতের মধ্যে এই ছবিগুলো বারবার আমার সামনে আসছে। (ছহীহ বুখারী হা/৩৭৪; মিশকাত হা/৭৫৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭০২।)

নকশা দেখে রাসূল (ছাঃ) যদি ফেতনার আশংকা করেন তাহলে আমাদের ছালাতের অবস্থা কী হবে? আমরা কি তাঁর চেয়ে বেশী তাক্বওয়াশীল?

বিভিন্ন বস্তুকে যদি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া জায়েয হত তবে সবচেয়ে সম্মানের অধিকারী হত হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথর। কিন্তু ওমর (রাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
 
আবেস ইবনু রাবীআহ ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একদা কালো পাথরের (হাজরে আসওয়াদ) নিকট আসেন এবং তাকে চুম্বন করেন। অতঃপর বলেন, নিশ্চয়ই আমি জানি তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কোন ক্ষতিও করতে পারো না কোন উপকারও করতে পারো না। আমি যদি রাসূল (ছাঃ)-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।(ছহীহ বুখারী হা/১৫৯৭, হজ্জ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫০; ছহীহ মুসলিম হা/৩১২৬; মিশকাত হা/২৫৮৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৪৭৩, ৫/২১৪ পৃঃ।)

চাঁদ-তারাকে ইসলামের নিশান মনে করে মসজিদের দেওয়ালে খোদাই করা হয়। অথচ উক্ত ধারণা সঠিক নয়। এগুলো আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহকেই ভক্তি করতে হবে এবং তাঁর প্রশংসা করতে হবে। কোন কোন মসজিদে যোগ চিহ্ন দেওয়া থাকে নিদর্শন স্বরূপ। অথচ এটা খ্রীস্টানদের প্রতীক। (ছহীহ মুসলিম হা/৪০৮; মিশকাত হা/৫৫০৬।) আল্লাহ তাআলা বলেন,

আর রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র তাঁর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। তোমরা সূর্য ও চন্দ্রকে সিজদা করো না। বরং তোমরা সিজদা করো আল্লাহকে যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে থাকো (হামীম সাজদাহ/ফুচ্ছিলাত ৩৭)। সুতরাং চন্দ্র-সূর্য ও তারকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। এর দ্বারা নকশা করে মসজিদকে অতিরঞ্জিত করার পক্ষে শরীআতের অনুমোদ নেই।
 
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
মসজিদ সমূহকে উচ্চ ও চাকচিক্যময় করে নির্মাণ করার জন্য আমি আদিষ্ট হইনি। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অবশ্যই তোমরা মসজিদগুলোকে চাকচিক্যময় করবে যেভাবে ইহুদী-খ্রীস্টানরা (গীর্জা) চাকচিক্যময় করেছে।(ছহীহ আবূদাঊদ হা/৪৪৮, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৭১৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৬৫, ২/২২২।)

বর্তমানে মানুষ মসজিদের নকশা করতে অহংকারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথচ এটাকে রাসূল (ছাঃ) ক্বিয়ামতের আলামত হিসাবে অভিহিত করেছেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, মসজিদ নিয়ে মানুষের পরস্পরের গর্ব প্রকাশ করা ক্বিয়ামতের আলামত।(আবূদাঊদ হা/৪৪; নাসাঈ হা/৬৮৯; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৭১৯।)

রাসূল (ছাঃ) ছালাতের স্থানকে যাবতীয় ত্রুটিমুক্ত রাখতে কাবা চত্বর থেকে সমস্ত মূর্তি ও ছবি অপসারণ করেছিলেন। (ছহীহ বুখারী হা/২৪৭৮, মাযালেম অধ্যায়; ছহীহ মুসলিম হা/৪৭২৫।)

মুসলিম উম্মাহর দুর্ভাগ্য হল, তারা আজ সেই ছালাতের স্থানকে বিভিন্নরূপে সাজিয়ে ছালাতের অনুপোযোগী করে তুলছে। পূর্বের মসজিদগুলো ছিল কাঁচা কিন্তু মানুষের ঈমান ছিল পাকা, হৃদয় ছিল তাক্বওয়ায় পরিপূর্ণ। বর্তমানে মসজিদগুলো অত্যাধুনিক টাইলস, গ্লাস, এসি, দামী পাথর দ্বারা সজ্জিত করা হচ্ছে, মুছল্লীর পোশাক ও জায়নামায হচ্ছে ঝকঝকে উজ্জ্বল। কিন্তু দেহের শ্রেষ্ঠ অংশ অন্তরটা কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাক্বওয়া ও ঈমানের পরিচর্যা না হয়ে চলছে কেবল বস্তুর পরিচর্যা এবং লৌকিকতার প্রতিযোগিতা। অতএব সর্বাগ্রে নিজের হৃদয়কে ঈমান ও তাক্বওয়ার টাইলস দ্বারা উজ্জ্বল করতে হবে, একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সুন্দর করতে হবে।

(৬) ইট-বালি-সিমেন্ট ও টাইলস দ্বারা মিম্বার তৈরি করা ও তিন স্তরের বেশী স্তর বানানো :
অধিকাংশ মসজিদে মূল্যবান পাথর বা টাইলস দ্বারা মিম্বার তৈরি করা হয়েছে। অথচ সুন্নাত হ
ল কাঠ দ্বারা মিম্বার তৈরী করা এবং মিম্বারের তিনটি স্তর হওয়া। যেমন হাদীছে এসেছে,

রাসূল (ছাঃ) জনৈক আনছারী মহিলার নিকট লোক পাঠান। তার নাম সাহল। এই মর্মে যে, তুমি তোমার কাঠমিস্ত্রী গোলামকে নির্দেশ দাও সে যেন আমার জন্য একটি কাঠের আসন তৈরি করে। যার উপর বসে আমি জনগণের সাথে কথা বলব। ঐ মহিলা তার গোলামকে উক্ত মর্মে নির্দেশ দিলে সে গাবার ঝাউ কাঠ দিয়ে তা তৈরি করে নিয়ে আসে। অতঃপর মহিলা তা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দেয়। রাসূল (ছাঃ) তাকে এই স্থানে স্থাপন করার নির্দেশ দেন। (ছহীহ বুখারী হা/৯১৭; মিশকাত হা/১১১৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৪৫, ৩/৬৫, কাতারে দাঁড়ানো অনুচ্ছেদ।)

উক্ত হাদীছ ইবনু খুযায়মাতে ছহীহ সনদে এসেছে, অতঃপর সে গাবার ঝাউ গাছ থেকে তিন স্তর বিশিষ্ট মিম্বার তৈরি করেছিল। (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫২১; ইবনু মাজাহ হা/১৪১৪; মুসনাদে আহমাদ হা/২২৯২২; মুস্তাদরাক হাকেম হা/৭২৫৬; সনদ ছহীহ, আলবানী, আছ-ছামারুল মুস্তাতাব, পৃঃ ৪০৮।)

তাবারাণীতে এসেছে, তিন স্তর বিশিষ্ট করার জন্য রাসূল (ছাঃ)-ই নির্দেশ দিয়েছিলেন। (তাবারাণী, আল-মুজামুল কাবীর হা/৫৭৪৮; সনদ ছহীহ, আলবানী, আছ-ছামারুল মুস্তাতাব, পৃঃ ৪০৮।)

এছাড়া রাসূল (ছাঃ) একদা মিম্বারের তিন স্তরে উঠে তিনবার আমীন বলেন মর্মেও ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। (মুস্তাদরাক হাকেম হা/৭২৫৬; সনদ ছহীহ।)
অতএব মিম্বার তিন স্তরের বেশী করা সুন্নাতের বরখেলাফ। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৫, ১/৩৩৪ পৃঃ।)

অনুরূপ ইট, পাথর ও টাইলস দ্বারা তৈরি মিম্বারও সুন্নাতের পরিপন্থী। এধরনের মিম্বার সরিয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট কাঠের মিম্বার তৈরি করে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

(৭) পিলার বা দেওয়ালের মাঝে কাতার করা :
সমাজে বহু মসজিদ আছে এবং বর্তমানেও অনেক মসজিদ  তৈরি হচ্ছে যেগুলোতে কাতারের মাঝে পিলার দেওয়া হচ্ছে। কোন কোন মসজিদে কাতারের মাঝে ওয়াল রয়েছে এবং অপর পার্শ্ব থেকে কাতার করা হয়। অথচ জামা
আতে ছালাত আদায় করার সময় কাতারের মাঝে পিলার বা ওয়াল দেওয়া শরীআতে নিষিদ্ধ।

মুআবিয়াহ ইবনু কুর্রা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে আমাদেরকে নিষেধ করা হত আমরা যেন খুঁটির মাঝে ছালাতের কাতার না করি।(ইবনু মাজাহ হা/১০০২, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৫, ১/৩৩৪ পৃঃ।)

 আলবানী (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ দুই খুঁটির মাঝখানে কাতারবন্দী না হওয়ার সুস্পষ্ট দলীল। তাই ওয়াজিব হল খুঁটি থেকে সামনে কিংবা পিছনে দাঁড়ানো। (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৫, ১/৩৩৪ পৃঃ।)
উল্লেখ্য যে, দুই পিলারের মাঝে দাঁড়িয়ে একাকী ছালাত আদায় করা যাবে।(ছহীহ বুখারী হা/৫০৪ ও ৫০৫।) 

(৮) মসজিদে প্রবেশ করে সরাসরি বসে পড়া :
এই অভ্যাস সুন্নাতের সরাসরি বিরোধী এবং মসজিদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার শামিল। রাসূল (ছাঃ) এটাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

আবু ক্বাতাদা সুলামী থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন সে যেন বসার পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করে।(ছহীহ বুখারী হা/৪৪৪, ছালাত অধ্যায়, কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে তখন দুই রাকআত ছালাত আদায় করবে অনুচ্ছেদ; ছহীহ মুসলিম হা/১৬৮৭; মিশকাত হা/৭০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৫২, ২/২১৭ পৃঃ।)

আবু ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন সে যেন না বসে, যতক্ষণ দুই রাকআত ছালাত না পড়বে।(ছহীহ বুখারী হা/১১৬৩, রাত্রির ছালাত দুই দুই রাকআত অনুচ্ছেদ।)

এমনকি জুমআর দিনে খুৎবা অবস্থায় যদি কেউ মসজিদে প্রবেশ করে তবুও তাকে দুই রাকআত ছালাত আদায় করে বসতে হবে।

জাবের (রাঃ) বলেন,
নবী করীম (ছাঃ) জুমআর দিনে খুৎবা দিচ্ছিলেন এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি ছালাত আদায় করেছ? সে বলল, না। তখন তিনি বললেন, তুমি দাঁড়াও দুই রাকআত ছালাত আদায় কর।(ছহীহ বুখারী হা/৯৩০ ও ৯৩১, জুমআর ছালাত অধ্যায়; ছহীহ মুসলিম হা/২০৫৫ ও ২০৫৬।)

(৯) সর্বদা মসজিদে নির্দিষ্ট স্থানে ছালাত আদায় করা :
অনেকের মাঝে এই অভ্যাস পরিলক্ষিত হয়। এটা ইসলামে নিষিদ্ধ।

আব্দুর রহমান ইবনু শিবল বলেন, রাসূল (ছাঃ) তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন : (১) ছালাতের মধ্যে কাকের মত ঠোকাতে (২) চতুষ্পদ জন্তুর মত হাত বিছিয়ে দিতে এবং (৩) ছালাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করতে যেমন উট তার স্থান নির্ধারণ করে।(ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/১৪২৯; আবূদাঊদ হা/৮৬২।)

মুছল্লী ফরয ছালাত যেখানে আদায় করবে সেখান থেকে ডানে বা বামে, সামনে বা পিছনে সরে গিয়ে সুন্নাত ছালাত আদায় করার নির্দেশ হাদীছে এসেছে। (ইবনু মাজাহ হা/১৪২৭; আবূদাঊদ হা/১০০৬, ছালাত অধ্যায়, সুন্নাত ছালাত ফরয ছালাতের স্থান থেকে সরে গিয়ে পড়া অনুচ্ছেদ।)
এমনকি ইমামকেও তার স্থানে সুন্নাত পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। (আবূদাঊদ হা/৬১৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪২৮।)

(১০) বেশী নেকীর আশায় বড় মসজিদে গমন করা :
অনেকে বাড়ীর পার্শ্বে ছোট মসজিদ রেখে বেশী নেকীর আশায় বড় মসজিদে গমন করেন। এটি শরী
আত বিরোধী আক্বীদা। এই আক্বীদা সঠিক হলে বড় মসজিদ ছাড়া ছোট মসজিদ তৈরি করা নাজায়েয হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ওয়াক্তিয়া মসজিদের চেয়ে জুমআ মসজিদে ছালাত আদায় করলে ৫০০ গুণ নেকী বেশী হবে মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ছহীহ নয়, যা পূর্বে আলোচিত হয়েছে। (ইবনু মাজাহ হা/১৩৭৫; মিশকাত হা/৭৫২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৯৬, ২/২৩৫ পৃঃ; আলবানী, আছ-ছামারুল মুস্তাত্বাব, পৃঃ ৫৮০।)
তাই তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদে বেশী নেকীর আশায় যাওয়া যাবে না। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আক্বছা। (ছহীহ বুখারী হা/১১৮৯; মিশকাত হা/৬৯৩।)

(১১) লাল বাতি জ্বললে সুন্নাতের নিয়ত করবেন না :
উক্ত সতর্কতা মুছল্লীকে ছালাত ও তার নেকী থেকে বঞ্চিত করেছে। কারণ সুন্নাত ছালাত আদায়কালীন যদি ইক্বামত হয়ে যায় তাহ
লে হাদীছের নির্দেশ, সে ছালাত ছেড়ে দিবে এবং ফরয ছালাতে শরীক হতে হবে। এতে করে সে উক্ত ছালাতের নেকী পেয়ে যাবে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
যে ব্যক্তি একটি ভাল কাজ করার ইচ্ছা করল কিন্তু তা করল না তার জন্য একটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হল। কিন্তু যে ব্যক্তি একটি ভাল কাজ করার ইচ্ছা করল এবং তা করে ফেলল তার জন্য দশ থেকে সাতশ গুণ নেকী লিপিবদ্ধ করা হল ...।(ছহীহ মুসলিম হা/৩৫৪ ও ৩৫৫, ঈমান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬১; ছহীহ বুখারী হা/৬৪৯১, রিক্বাক্ব অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩১; মিশকাত হা/২৩৭৪।)

উল্লেখ্য যে, লাল বাতির গুরুত্ব কিন্তু ফজরের দুই রাকআত সুন্নাতের সময় থাকে না। কারণ বহু মসজিদে ফজরের জামাআত চললেও আগে সুন্নাত পড়তে দেখা যায়। অথচ হাদীছের নির্দেশ হল, ছালাতের ইক্বামত হয়ে গেলে আর কোন ছালাত চলবে না। ফরয ছালাতে অংশগ্রহণ করতে হবে।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
যখন ছালাতের ইক্বামত দেওয়া হবে তখন ফরয ছালাত ছাড়া অন্য কোন ছালাত নেই।(ছহীহ মুসলিম হা/১৬৭৮ ও ৭৯, মুসাফিরদের ছালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯; মিশকাত হা/১০৫৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৯১, ৩/৪৬ পৃঃ, ছালাতের জামাআত ও তার ফযীলত অনুচ্ছেদ; ছহীহ বুখারী হা/৬৬৩।)

ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, ফজরের ছালাতের পরে সুন্নাত পড়া যাবে না। অথচ কেউ পূর্বে সুন্নাত পড়তে না পারলে ছালাতের পরে পড়ে নেওয়ার ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। (আবূদাঊদ হা/১২৬৭, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/১০৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৭৭, ৩/৪০ পৃঃ, ছালাতের নিষিদ্ধ ওয়াক্ত সমূহ অনুচ্ছেদ।)

(১২) মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা :
মসজিদ ছালাতের স্থান। এখানে কোন কন্ঠ উঁচু করে কথা বলা চলে না। এটা মসজিদের মর্যাদার খেলাফ। বিশেষ করে জামা
আত শুরুর আগে যে মসজিদ বাজারে পরিণত হয় তা থেকে রাসূল (ছাঃ) কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন ।(ছহীহ মুসলিম হা/১০০২, ছালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৮; মিশকাত হা/১০৮৯, কাতার সোজা করা অনুচ্ছেদ।)
জনৈক ব্যক্তি জোরে কথা বললে রাসূল (ছাঃ) রেগে বাড়ী থেকে বেরিয়ে তাকে এসে ধমক দেন। (ছহীহ বুখারী হা/৪৭১।)

ওমর (রাঃ) এজন্য দুই ব্যক্তিকে শাসিয়ে দেন  তোমরা যদি এই মদীনা শহরের বাসিন্দা হতে তবে মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলার কারণে আমি দুজনকেই কঠোর শাস্তি দিতাম।(ছহীহ বুখারী হা/৪৭০; মিশকাত হা/৭৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৮৮, ২/২৩০ পৃঃ, মসজিদ সমূহ অনুচ্ছেদ।)

(১৩) মসজিদে হারানো বিজ্ঞপ্তি ও মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা :
এটা সম্পূর্ণ শরী
আত বিরোধী এবং মসজিদের আদবের চরম খেলাফ।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্য কাউকে মসজিদে হারানো জিনিষ খোঁজ করতে শুনবে সে যেন বলে আল্লাহ যেন তোমাকে ফেরত না দেন। কারণ মসজিদ সমূহ এ জন্য তৈরি করা হয়নি। (ছহীহ মুসলিম হা/১২৮৮; মিশকাত হা/৭০৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৫৪, ২/২১৮ পৃঃ।)

মৃত সংবাদ প্রচার করা জাহেলী আদর্শ। এ ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হুযায়ফাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু সংবাদ প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। (তিরমিযী হা/৯৮৬; ইবনু মাজাহ হা/১৪৭৬, সনদ হাসান।)

মৃত্যু সংবাদ প্রচারের নামে শোক প্রকাশ করে কোন লাভ হয় না। শুধু লোক দেখানোই হয়। তার প্রমাণ হল সব জানাযাতে লোকের সংখ্যা এক রকম হয় না। কারো জানাযায় হাযার হাযার লোক হয় আবার কারো জানাযায় একশ লোকও জুটে না। অথচ মাইকিং সবার জন্যই করা  হয়। সুতরাং এতে কোন ফায়েদা নেই; বরং এটা ব্যক্তির প্রসিদ্ধি ও গুণের কারণ। তাছাড়া শুভাকাঙ্খী হলে এমনিতেই সে মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাবে, মাইকিং করে জানানো লাগবে না।

উল্লেখ্য যে, মারা যাওয়ার পূর্বে প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত তার উত্তরসূরী ও আত্মীয়-স্বজনকে অছিয়ত করে যাওয়া, যেন তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিদআতী কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত না হয়। বিশেষ করে বিলাপ করা ও বিভিন্ন কথার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করা। কারণ সাবধান করে না গেলে বা এর প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে এজন্য তাকে কবরে শাস্তি দেওয়া হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,

তোমরা কি শুননি, নিশ্চয়ই আল্লাহ চোখের কান্না ও অন্তরের চিন্তার কারণে শাস্তি দিবেন না; বরং তিনি শাস্তি দিবেন এর কারণে। অতঃপর তিনি তার জিহবার দিকে ইঙ্গিত করলেন। অথবা তার উপর রহম করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মাইয়েতকে তার পরিবারের কান্নার কারণে শাস্তি দেন। ওমর (রাঃ) এজন্য লাঠিপেটা করতেন, পাথর মারতেন এবং মাটি নিক্ষেপ করতেন। (ছহীহ বুখারী হা/১৩০৪; ছহীহ মুসলিম হা/২১৭৬; মিশকাত হা/১৭২৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৬৩২, ৪/৮৪, জানাজা অধ্যায়।)

(১৪) মুছল্লীর সামনে সুতরা রেখে চলে যাওয়া :
এটা শহরের মসজিদগুলোতে বর্তমানে বেশী দেখা যাচ্ছে। শরী
আতে এর কোন অনুমোদন নেই। কারণ রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে এ ধরনের কৌশলের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং মুছল্লীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করার চেয়ে ৪০ বছর যাবৎ বসে থাকা উত্তম বলা হয়েছে। (ছহীহ বুখারী হা/৫১০; মিশকাত হা/৭৭৬।)

বর্তমান পদ্ধতিতে যাওয়া বৈধ হলে রাসূল (ছাঃ) তা বলে যেতেন। সুতরাং মুছল্লীর সামনে সুতরা দিয়ে অতিক্রম করা আর এমনি চলে যাওয়া একই সমান। এই অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। উল্লেখ্য যে, যিনি ছালাত আদায় করবেন তিনি নিজে সামনে সুতরা রেখে ছালাত শুরু করলে। (মুসলিম, মিশকাত হা/৭৭৫।) এর সামনে দিয়ে মুছল্লীগণ যেতে পারবেন। তবে সুতরা বিহীন ছালাত আদায়কারী মুছল্লীর সামনে অন্য মুছল্লী সুতরা রেখে অতিক্রম করতে পারবেন না।

(১৫) মসজিদে বিদআতী কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়া :
আল্লাহর ঘর মসজিদে বিদ
আতী কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়া জঘন্য অপরাধ। অনেক মসজিদে শিরক ও বিদআত মিশ্রিত প্রচারপত্র ও লিফলেট ও দামী তাসবীহ ঝুলতে দেখা যায়। অথচ ছাহাবায়ে কেরাম মসজিদে বিদআতী কর্মকান্ড হওয়াকে গুরুতর অপরাধ মনে করতেন।

মুজাহিদ (রাঃ) বলেন, আমি একদা ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম। যোহর কিংবা আছরের আযানের পর জনৈক ব্যক্তি মানুষকে ডাকাডাকি করছে। তখন ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, তোমরা আমাকে এই মসজিদ থেকে বের করে নাও। কারণ এটা বিদ
আত। (ছহীহ আবূদাঊদ হা/৫৩৮, সনদ হাসান।)

বিদআতের ঘৃনায় তিনি উক্ত মসজিদে ছালাত আদায় না করে বেরিয়ে আসেন। বর্তমানে মসজিদগুলোতে সকাল-সন্ধ্যায় বিদআতী যিকিরের মজলিস বসানো হচ্ছে, গোল হয়ে বসে মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে, তাসবীহ দানা দ্বারা তাসবীহ জপা হচ্ছে, নিজেদের রচিত উদ্ভট যিকির-আযকারের মেলা বসাচ্ছে । এ সমস্ত শরীআত বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ছাহাবীগণ ছিলেন খড়গহস্ত। (দারেমী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০০৫, সনদ ছহীহ।)

ছালত ইবনু বুহরাম (রাঃ) বলেন,
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এক মহিলার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে দানা ছিল। তা দ্বারা সেই মহিলা তাসবীহ গণনা করছিল। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সেগুলো কেড়ে নিলেন এবং দূরে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর একজন লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন সে পাথর কংকর দ্বারা তাসবীহ গণনা করছিল। ইবনু মাসঊদ তাকে নিজের পা দ্বারা লাত্থি মারলেন। তারপর বললেন, তোমরা অগ্রগামী হয়েছ! আর অন্ধকার বিদআতের উপর আরোহন করেছ! তোমরাই কি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবী হিসাবে ইলমের দিক থেকে বিজয়ী হয়েছ! (ইবনু ওয়াযযাহ, আল-বিদউ, পৃঃ ২৩, হা/২১; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৩-এর আলোচনা দ্রঃ, সনদ ছহীহ।)

মসজিদ কমিটিকে শরীআত বিরোধী উক্ত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কারণ তারা বিদআতীকে আশ্রয় দিলে তাদেরও কোন ফরয কিংবা নফল ইবাদত কবুল হবে না। (ছহীহ বুখারী হা/৭৩০০, তেছাম অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; ছহীহ মুসলিম হা/৩৩৯৩, হজ্জ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৫; মিশকাত হা/২৭২৮।)
 (চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন