বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১১

জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত – ৭


জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত

ছালাতের ফযীলত
ছালাতের ফযীলত সংক্রান্ত উদ্ভট ও মিথ্যা কাহিনী সমূহ :
জনগণকে ছালাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য
ফাযায়েলে আমলের মধ্যে এমন কিছু তথ্য ও কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, আজগুবি ও অবাস্তব। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হল:


(১) জামাআতের সাথে এক ওয়াক্ত ছালাতের নেকী তিন কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ চুয়ান্ন হাযার চারশ বত্রিশ গুণ। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১২৫; (উর্দূ), ফাযায়েলে নামায অংশ, পৃঃ ৪৫।)


পর্যালোচনা : হাদীছে বলা হয়েছে যে, জামাআতে ছালাত আদায় করলে একাকী পড়ার চেয়ে ২৫ গুণ বা ২৭ গুণ বেশী ছওয়াব পাওয়া যাবে। (ছহীহ বুখারী হা/৪৭৭, ছালাত অধ্যায়, বাজারের মসজিদে ছালাত অনুচ্ছে এবং হা/৬৪৫, আযান, অধ্যায়, জামাআতে ছালাতের ফযীলত অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১০৫২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৮৫, ৩/৪৪ পৃঃ।) অন্য হাদীছে রয়েছে, পঁচিশটি ছালাতের নেকী হবে। (আবুদাঊদ হা/৫৬০।) উক্ত দুই হাদীছের ফযীলতের উদ্ভট ব্যাখ্যা দিয়ে কোটি কোটি বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।


(২) সাঈদ ইবনু মুসাইয়িব (রহঃ) পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এশা ও ফজরের ছালাত একই ওযূ দ্বারা পড়েছেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০; (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।)


(৩) চল্লিশ জন তাবেঈ সম্পর্কে অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা এশা ও ফজর একই ওযূতে পড়তেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।)


(৪) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ত্রিশ বছর কিংবা চল্লিশ বছর কিংবা পঞ্চাশ বছর এশা ও ফজর ছালাত একই ওযূতে পড়েছেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (ঊর্দূ), পৃঃ ৬৮।) তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ওযূর পানি ঝরার সময় তিনি বুঝতে পারতেন এর সাথে কোন পাপ ঝরে যাচ্ছে। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ৭৮।)


ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফাযিল স্নাতক প্রথম বর্ষের আল-আক্বাঈদ বইয়ে আবু হানীফা (রহঃ)-এর গুণাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি একাধারে ৩০ বছর রোযা রেখেছেন এবং ৪০ বছর যাবত রাতে ঘুমাননি। ইবাদত বন্দিগীতে রজনী কাটায়ে গিয়েছেন। প্রতি রামাযানে ৬১ বার কুরআন মাজীদ খতম করতেন। অনেক সময় এক রাকয়াতেই কুরআন মাজীদ এক খতম দিতেন। তিনি ৫৫ বার হজ্জ করেছেন। জীবনের শেষ হজ্জের সময় কাবা শরীফে দুরাকয়াত নামায এভাবে পড়েন যে, প্রথম রাকয়াতে এক পা ওঠায়ে প্রথম অর্ধাংশ কুরআন মাজীদ পাঠ করেন। তারপর দ্বিতীয় রাকয়াতে অপর পা ওঠায়ে বাকি অর্ধাংশ কুরআন মাজীদ পাঠ করেন। যে স্থানে তাঁর ইন্তিকাল হয়েছে, সেখানে এক হাজার বার কুরআন মাজীদ খতম করেছেন। তিনি ৯৯ বার আল্লাহ তায়ালাকে স্বপ্নে দেখেছেন।( রচনা ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহাম্মদ আবু ইউসুফ খান, আল-আকাইদ আল-ইসলামিয়্যাহ (ঢাকা : আল-বারাকা লাইব্রেরী, ৩৪, নর্থব্রূক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০), পৃঃ ৪৫।)


(৫) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) রামাযান মাসে ছালাতের মধ্যে পবিত্র কুরআন ৬০ বার খতম করতেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।)


(৬) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) দৈনিক ৩০০ রাকআত ছালাত আদায় করতেন। ৮০ বছর বয়সে তিনি দৈনিক ১৫০ রাকআত ছালাত আদায় করতেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, ১৫৮, (উর্দূ), পৃঃ ৬৬ ও ৬৮।)


(৭) সাঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ) এক রাকআতে পুরা কুরআন খতম করতেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৮, (উর্দূ), পৃঃ ৬৬।)


(৮) আবু আত্তার সুলামী (রহঃ) চল্লিশ বছর পর্যন্ত সারা রাত ক্রন্দন করে কাটাতেন এবং দিনে সর্বদা ছিয়াম পালন করতেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬১, (উর্দূ), পৃঃ ৬৮।)


(৯) বাকী ইবনু মুখাল্লাদ (রহঃ) দৈনিক তাহাজ্জুদ ও বিতর ছালাতের তের রাকআতে কুরআন খতম করতেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৬০, (উর্দূ), পৃঃ ৬৭।)


(১০) মুহাম্মাদ ইবনু সালামা ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর ছাত্র ছিলেন । তিনি ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। ঐ বয়সে তিনি প্রতিদিন ২০০ রাকআত করে ছালাত আদায় করতেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর তার একটানা তাকবীরে তাহরীমা ছুটেনি। মায়ের মৃত্যুর কারণে মাত্র একবার ছুটে গিয়েছিল। জামাআতে না পড়ার জন্য তিনি ঐ ছালাত ২৫ বার পড়েন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১২৫-১২৬, (উর্দূ), পৃঃ ৪৬।)


(১১) ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) সারা রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এমনকি খেলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার পর তার ফরয গোসলের প্রয়োজন হয়নি। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৭, (উর্দূ), পৃঃ ৬৫-৬৬।)


(১২) জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তির পায়ে ফোঁড়া হয়েছিল। ডাক্তারগণ পরামর্শ দিলেন, পা না কাটা হলে জীবনের হুমকি রয়েছে। তখন তার মা বললেন, যখন ছালাতে দাঁড়াবে তখন কেটে নিতে হবে। অতঃপর তিনি যখন ছালাতে দাঁড়ালেন তখন তারা তার পা কেটে ফেললে তিনি মোটেও টের পেলেন না। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৬, (উর্দূ), পৃঃ ৬৫।)


উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ) সম্পর্কে এধরনের একটি কাহিনী প্রচার করা হয় যে, যুদ্ধে তার পায়ে তীর বিদ্ধ হয়েছিল। সেই তীর বের করা যাচ্ছিল না। অবশেষে তিনি ছালাতে দাঁড়ালে তার পা থেকে তীর বের করা হল অথচ তিনি টের পেলেন না। এই কাহিনীও মিথ্যা।


পর্যালোচনা : সুধী পাঠক! উক্ত কাহিনীগুলো মুসলিম বিশ্বের বরণীয় মনীষীদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, তারা কি আদৌ এভাবে তাদের ইবাদতী জীবন অতিবাহিত করেছেন? তাদের দ্বারা কি এধরনের বাড়াবাড়ি সম্ভব? যেমন-

(ক) দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর যাবৎ এশার ছালাতের ওযূ দ্বারা ফজরের ছালাত আদায় করা। বছরের পর বছর একটানা ছিয়াম পালন করা ইত্যাদি। মানবীয় কারণ উল্লেখ না করে যদি প্রশ্ন করা হয়- শরীআতে এভাবে সারা রাত ধরে ইবাদত করার অনুমোদন আছে কি? রাসূল (ছাঃ) ও তার ছাহাবীদের পক্ষ থেকে এরূপ কি কোন নযীর আছে? আল্লাহ তাআলা রাসূল (ছাঃ)-কে রাত্রের কিছু অংশ বাদ দিয়ে ইবাদত করতে বলেছেন (মুয্যাম্মিল ২-৪)। রাসূল (ছাঃ) ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনু আছ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি ছিয়াম পালন কর আবার ছিয়াম ছেড়ে দাও, তুমি রাত্রে ইবাদত কর আবার ঘুমাও। কারণ তোমার উপর তোমার শরীরের হক আছে, তোমার উপর তোমার দুই চোখের হক আছে, অনুরূপ তোমার উপর তোমার স্ত্রীর হক আছে।( ছহীহ বুখারী হা/৫১৯৯, ২/৭৮৩ পৃঃ, বিবাহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৮৮; মিশকাত হা/২০৫৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৯৫৬, ৪/২৫৩ পৃঃ, ছিয়াম অধ্যায়, নফল ছিয়াম অনুচ্ছেদ।)

রাসূল (ছাঃ) অন্য হাদীছে বলেন, যে ব্যক্তি সর্বদা ছিয়াম পালন করে তার ছিয়ামের কোন মূল্য নেই। একথা তিনি দুইবার বলেন।( ছহীহ বুখারী হা/১৯৭৭, ১/২৬৫ পৃঃ, ছিয়াম অধ্যায়, ছিয়ামের ক্ষেত্রে পরিবারের হক অনুচ্ছেদ-৫৬।)


(খ) প্রতিদিন ৩০০, ২৫০ কিংবা ২০০ রাকআত ছালাত আদায় করা। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম এধরনে কোন ইবাদত করেছেন মর্মে প্রমাণ নেই। জানা আবশ্যক যে, রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বা ব্যতীত যেকোন ইবাদত প্রত্যাখ্যাত। (ছহীহ মুসলিম হা/৪৪৬৮, ২/৭৭।) বরং শরীআতের বিধিবদ্ধ নিয়মকে অবজ্ঞা করে যে বেশী বেশী ইবাদত করবে নিঃসন্দেহে সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত থেকে বহিষ্কৃত হবে। কারণ রাসূল (ছাঃ) ইবাদতের কথা জেনে তিন ব্যক্তি খুব কম মনে করেছিল এবং তারা বেশী বেশী ইবাদত করতে চেয়েছিল। এদের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলে দিলেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।(ছহীহ বুখারী হা/৫০৬৩, ২/৭৫৭ পৃঃ, বিবাহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; ছহীহ মুসলিম হা/৩৪৬৯, বিবাহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১ এবং হা/২৫০০; মিশকাত হা/১৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭, ১/১০৯ পৃঃ)


(গ) ছালাতে কুরআন খতম করা। এক রাকআতে পুরো কুরআন খতম করা এবং রামাযান মাসে শুধু তারাবীহ ছালাতে ৬০ বার খতম করা। এ হিসাবে প্রত্যেক রাতে দুইবার করে খতম করতে হয়েছে। এটা সম্ভব কি-না তা যাচাই করবেন পাঠকবৃন্দ। তবে স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)ও এভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে রাতের ছালাত আদায় করেননি। তিনি একবার এক রাকআতে সর্বোচ্চ সূরা বাক্বারাহ, নিসা ও আলে ইমরান পড়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। (ছহীহ মুসলিম হা/১৮৫০, ১/২৬৪ পৃঃ, মুসাফিরদের ছালাত অধ্যায়, রাত্রির ছালাতে ক্বিরাআত লম্বা করা মুস্তাহাব অনুচ্ছেদ-২৭।) জনৈক ছাহাবী সাত দিনের কমে কুরআন খতম করতে চাইলে রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দেননি। (ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৬, পৃঃ ৯৫ ও ৯৬, ছালাত অধ্যায়, কয় দিনে কুরআন খতম করা ভাল অনুচ্ছেদ-১৭৮।) তিনি তিন দিনের কমে কুরআন খতম করতে নিষেধ করেছেন। (তিরমিযী হা/২৯৪৯, ২/১২৩ পৃঃ, ক্বিরাআত অধ্যায়ের শেষ হাদীছ; ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৭; মিশকাত হা/২২০১, ফাযায়েলুল কুরআন অধ্যায়, কুরআন পাঠের আদব অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২০৯৭, ৫/৩৬ পৃঃ।) তাছাড়া আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি জানি না যে, রাসূল (ছাঃ) কোন এক রাত্রিতে পুরো কুরআন খতম করেছেন, কোন রাত্রে পুরো রাত ছালাত আদায় করেছেন এবং রামাযান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে সম্পূর্ণ মাস ছিয়াম পালন করেছেন। (ছহীহ মুসলিম হা/১৭৭৩, ১/২৫৬ পৃঃ, মুসাফিরদের ছালাত অধ্যায়, রাত্রির ছালাত ও যে ছালাত না পড়ে ঘুমে যায় অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত হা/১৫২৭, বিতর অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১১১৮, ৩/১৩১ পৃঃ।) এই নিয়মতান্ত্রিক নির্ধারিত ইবাদত করার মাধ্যমেই তিনি হয়েছেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তাকওয়াশীল। (ছহীহ বুখারী হা/৫০৬৩, ২/২৫৭ পৃঃ, বিবাহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/১৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭, ১/১০৯ পৃঃ।)


প্রশ্ন হল- যে সমস্ত মহা মনীষী সম্পর্কে উক্ত অলীক কাহিনী রচনা করা হয়েছে তারা কি শরীআতের এই বিধানগুলো জানতেন না? তারা কি রাসূল (ছাঃ) ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবীদের চেয়ে বেশী পরহেযগার হতে চেয়েছিলেন? (নাঊযুবিল্লাহ)। বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে যে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে তা আসলেই দুঃখজনক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বইয়ে কিভাবে তা সম্পৃক্ত হতে পারে? বলা যায় তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল এ সমস্ত অলীক কাহিনী আবিস্কার করেছে।


(১৩) ছাবেত আল-বুনানী (রহঃ) আল্লাহর সামনে অধিক ক্রন্দন করতেন আর বলতেন, হে আল্লাহ কবরে যদি কাউকে ছালাত আদায় করার অনুমতি দান করে থাকেন তাহলে আমাকে অনুমতি দিন। আবু সিনান বলেন, আল্লাহর কসম! ছাবেতকে যারা দাফন করেছেন তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। দাফনের সময় কবরের একটি ইট পড়ে গেল। আমি দেখতে পেলাম তিনি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। তার কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, আব্বা ৫০ বছর যাবৎ রাত্রি জাগরণ করেছেন এবং উক্ত দোআ করেছেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৯, (উর্দূ), পৃঃ ৬৭।)


(১৪) একজন স্ত্রীলোককে দাফন করা হল । তার ভাই দাফনের কাজে শরীক ছিল। এ সময় তার টাকার থলি কবরের মাঝে পড়ে যায়। পরে বুঝতে পেরে চুপে চুপে কবর খুলে বের করার চেষ্টা করে। যখন সে কবর খুলল তখন কবরটি আগুনে পরিপূর্ণ ছিল। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের নিকট আসল এবং ঘটনা বর্ণনা করল। তখন তার মা উত্তরে বলল, সে ছালাতে অলসতা করত এবং ছালাত ক্বাযা করত। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১১৮।)


পর্যালোচনা : কবর জীবন মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী জীবন। এই জীবন মানুষের বাস্তব জীবনের বিপরীত। দুনিয়ার কোন মানুষ বারযাখী জীবন সম্পর্কে খবর রাখে না। কবরের শান্তি বা শাস্তি কোনকিছু কেউ টের পায় না। সেখানকার অবস্থা দেখা তো দূরের কথা মানুষ ও জিনের পক্ষে কানে শুনাও সম্ভব নয়। (ছহীহ বুখারী হা/১৩৩৮, জানাযা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৬৬ ও ১৩৭৪; মিশকাত হা/১২৬ ও ১৩১।)


(১৫) শায়খ আব্দুল ওয়াহিদ (রহঃ) ছিলেন বিখ্যাত বুযুর্গের একজন। তিনি বলেন, আমার একবার খুব ঘুমের চাপ হল। ফলে রাত্রের নিয়মিত তাসবীহগুলো পড়তে ছুটে গেল। তখন স্বপ্নে আমি সবুজ রেশমী পোশাক পরিহিতা এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম। তার পায়ের জুতাগুলো পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ করছে। সে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, তুমি আমাকে পাওয়ার চেষ্টা কর, আমি তোমাকে পাওয়ার চেষ্টা করছি। অতঃপর সে কয়েকটি প্রেমমূলক কবিতা পাঠ করল। এই স্বপ্ন দেখে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, রাত্রে আর কখনো ঘুমাব না। অতঃপর তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এশার ওযূ দিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করেন। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫২, (উর্দূ), পৃঃ ৬২।)


(১৬) জনৈক বুযুর্গ বলেন, এক রাত্রিতে গভীর ঘুমের কারণে আমি জেগে থাকতে পারলাম না। ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে দেখলাম। এমন মেয়ে আমি কখনো জীবনে দেখিনি। তার দেহ থেকে তীব্র সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। এমন সুগন্ধি আমি কখনো অনুভব করিনি। সে আমাকে একটি কাগজের টুকরা দিল। তাতে কবিতার তিনটি চরণ লেখা ছিল। যেমন- তুমি নিদ্রার স্বাদে বিভোর হয়ে জান্নাতের বালাখানা সমূহ ভুলে গেছ, যেখানে তোমাকে চির জীবন থাকতে হবে, যেখানে কখনো মৃত্যু আসবে না। তুমি ঘুম হতে উঠ, কুরআন তেলাওয়াত কর, তাহাজ্জুদ ছালাতে কুরআন তেলাওয়াত করা ঘুম হতে অনেক উত্তম। তিনি বলেন, এই ঘটনার পর হতে আমার কখনো ঘুম আসে না। কবিতাগুলো স্মরণ হয় আর ঘুম দূরিভূত হয়ে যায়। (ফাযায়েলে আমল, পৃঃ ১৫৩, (উর্দূ), পৃঃ ৬৩।)


পর্যালোচনা : কি চমৎকার রোমাঞ্চকর উপন্যাস! সুন্দরী মেয়ের প্রলভন দেখিয়ে মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার কি সুন্দর অভিনব কৌশল! আল্লাহর ভয় ও ইসলামী বিধানের আনুগত্যের কোনই প্রয়োজন নেই। শুধু সুন্দরী নর্তকীকে পাওয়ার জন্য সে ইবাদত করবে। এটা কি কোন ইসলামী সভ্যতা?


সুধী পাঠক! ফাযায়েলে আমলে এ ধরনের অসংখ্য মিথ্যা কাহিনী রয়েছে। এই মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা দিয়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে প্রতারণার জালে আবদ্ধ করা হচ্ছে। এই পাতানো মরণ ফাঁদ হতে বিরত থেকে প্রমাণসহ ছহীহ দলীলের অনুসরণ করার জন্য আমরা সরলপ্রাণ মুমিন ভাইদেরকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহকে উক্ত মিথ্যা ও কাল্পনিক ধর্ম থেকে রক্ষা করুন-আমীন!!


ছালাতের ছহীহ ফযীলত সমূহ:
ছালাত তরককারীর হুকুম ও পরিণাম সম্পর্কে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। এক্ষণে ছালাতের ফযীলত সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর কয়েকটি বাণী নিম্নে পেশ করা হল। আল্লাহ তা
আলা বলেন, আর আপনি ছালাত আদায় করুন। নিশ্চয় ছালাত অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ (আনকাবূত ৪৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, আর আপনি দিনের দুই প্রান্তে এবং রাত্রির কিছু অংশে ছালাত আদায় করুন। নিংসন্দেহে সৎকর্ম সমূহ মন্দ কর্মসমূহকে দূর করে দেয় (হূদ ১১৪)

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলতেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুমআ হতে পরবর্তী জুমআ, এক রামাযান হতে পরবর্তী রামাযান এর মধ্যকার যাবতীয় পাপের কাফফারা স্বরূপ। যদি সে কাবীরা গোনাহ সমূহ থেকে বিরত থাকে ।( ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৪, ১/১২২ পৃঃ, পবিত্রতা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫; মিশকাত হা/৫৬৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫১৮, ২/১৫৮ পৃঃ, ছালাতের ফযীলত অনুচ্ছেদ।)

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের কারো বাড়ীর সামনে দিয়ে প্রবাহিত নদীতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করলে তোমাদের দেহে কোন ময়লা বাকী থাকবে কি? তারা বললেন, না বাকী থাকবে না। তিনি বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের তুলনা ঠিক অনুরূপ। আল্লাহ এর দ্বারা গোনাহ সমূহ বিদূরিত করেন।( মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী হা/৫২৮, ১/৭৬ পৃঃ, ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ অধ্যায়; মুসলিম হা/১৫৫৪, ১/২৩৫ পৃঃ, মসজিদ সমূহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫২; মিশকাত হা/৫৬৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫১৯, ২/১৫৮ পৃঃ।)

উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের প্রভু অত্যন্ত খুশি হন ঐ ছাগলের রাখালের প্রতি যে পর্বতশিখরে দাঁড়িয়ে ছালাতের আযান দেয় এবং ছালাত আদায় করে। তখন মহান আল্লাহ ফেরেশতাগণকে বলেন, তোমরা লক্ষ্য করো- সে আযান দেয় এবং ছালাত কায়েম করে এবং আমাকে ভয় করে। আমি আমার বান্দাকে মাফ করে দিলাম এবং জান্নাতে প্রবেশ করালাম। (আবূদাঊদ হা/১২০৩, ১/১৭০ পৃঃ; নাসাঈ হা/৬৬৬; মিশকাত হা/৬৬৫, আযানের ফযীলত অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬১৪, ২/২০২ পৃঃ।)

আমর ইবনু আবাসা (রা) হতে বর্ণিত, ... আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী (ছাঃ)! ওযূ সম্পর্কে বলুন। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন পানি সংগ্রহ করে কুলি করে এবং নাকে পানি দেয় অতঃপর নাক ঝাড়ে, নিশ্চয়ই তখন তার মুখমন্ডল, মুখের ভিতরের ও নাকের ভিতরের গোনাহ সমূহ ঝরে যায়। অতঃপর সে যখন চেহারা ধৌত করে যেরূপ আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন, তখন তার মুখমন্ডলের পানির সাথে পাপগুলো দাড়ির কিনারা দিয়ে ঝরে পড়ে। অতঃপর যখন সে দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করে তখন তার দুই হাতের পাপ সমূহ আঙ্গুলের ধার দিয়ে পানির সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে মাথা মাসাহ করে তখন তার মাথার পাপসমূহ চুলের পাশ দিয়ে ঝরে পড়ে। অবশেষে যখন সে দুই পা ধৌত করে দুই গিরা পর্যন্ত তখন তার গোনাহ সমূহ তার আঙ্গুল সমূহের কিনারা দিয়ে ঝরে পড়ে। অতঃপর সে যখন ছালাতের জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে এবং তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করে তিনি যেমন মর্যাদার অধিকারী। সেই সাথে নিজের অন্তরকে আল্লাহর জন্য নিবিষ্ট করে, তখন সে তার পাপ হতে অনুরূপ মুক্ত হয়ে যায় যেন তার মা তাকে সেদিন জন্ম দিয়েছে। (ছহীহ মুসলিম হা/১৯৬৭, ১/২৭৬, মুসাফিরের ছালাত অধ্যায়, আমর ইবনু আবাসার ইসলাম গ্রহণ অনুচ্ছেদ-৫২; মিশকাত হা/১০৪২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৭৫, ৩/৩৮ পৃঃ।)


আবু ক্বাতাদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, নিশ্চয় আমি আপনার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছি এবং আমার কাছে একটি অঙ্গীকার রেখেছি যে, যে ব্যক্তি ওয়াক্তমত সেই পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে আমি তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। আর যে ব্যক্তি সেগুলোর সংরক্ষণ করবে না তার জন্য আমার নিকট কোন অঙ্গীকার নেই।( ছহীহ আবুদাঊদ হা/৪৩০, সনদ হাসান, ছালাত অধ্যায়, ওয়াক্ত হেফাযত করা অনুচ্ছেদ।)

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, জামা
আতের সাথে ছালাত আদায় করা পঁচিশ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করার ন্যায়। যখন উক্ত ছালাত কোন নির্জন ভূখন্ডে আদায় করে অতঃপর রুকূ ও সিজদা পূর্ণভাবে করে তখন সেই ছালাত পঞ্চাশ ছালাতের সমপরিমাণ হয়। (আবুদাঊদ হা/৫৬০, সনদ ছহীহ।)


ছালাত সংক্রান্ত আরো  অনেক ফযীলত ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখেই আমাদেরকে আমল করতে হবে। যঈফ ও জাল হাদীছ এবং কাল্পনিক মিথ্যা কাহিনীর কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমাদেরকে বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায় করার তাওফীক দান করুন- আমীন!!
[চলবে]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন