বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১১

জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত – ৩


জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত

(৭) কুলুখ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা:
কুলুখ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা, কাশি দেওয়া, নাচানাচি করা, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা, টয়লেটে কুলুখের আবর্জনার স্তূপ তৈরি করা সবই নব্য মূর্খতা। ইসলামে এরূপ বেহায়াপনার কোন স্থান নেই। মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা মানুষকে এত নীচে নামিয়েছে। এই অভ্যাস ইসলামের বিশ্বজনীন মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত জীবন বিধান। যাবতীয় নোংরামী এতে নিষিদ্ধ। শরী
আতে পেশাব থেকে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে তাই বলে এর নামে নতুন আরেকটি বিদআত তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পেশাবের ছিটা কাপড়ে লেগে যাওয়ার আশংকায় ইসলাম তার জন্য সুন্দর বিধান দিয়েছে। আর তা হল, ওযূ করার পর হাতে পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দেওয়া। যেমন-
كَانَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا بَالَ يَتَوَضَّأُ وَيَنْتَضِحُ.
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন পেশাব করতেন তখন ওযূ করতেন এবং পানি ছিটিয়ে দিতেন।(ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৬৬ ও ৬৭, ১/২২ পৃঃ; মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৫১৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৪১; মিশকাত হা/৩৬৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৩৮, ২/৬৮ পৃঃ; ছহীহ নাসাঈ হা/১৬৮; মিশকাত হা/৩৬১; বঙ্গনুবাদ মিশকাত হা/৩৩৪, ২/৬৭ পৃঃ।)


অন্য হাদীছে এসেছে, কাপড়ে তরল মযী লাগলেও তিনি পানি ছিটিয়ে দিতে বলতেন। (ছহীহ আবুদাঊদ হা/২০৭, ১/২৭ পৃঃ।) অতএব প্রচলিত বেহায়াপনার আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।


(৮) ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা যাবে না এবং ইস্তিঞ্জা করার পর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযূ করা যাবে না বলে ধারণা করা:
উক্ত বিশ্বাস সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এ ধরনে কোন নির্দেশনা পাওয়া যায় না। অথচ তাঁরা পাত্রে ওযূ করতেন এবং পাত্রের পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা সম্পন্ন করতেন। (ছহীহ বুখারী হা/১৫০-১৫২; ছহীহ মুসলিম হা/৬৪৩; মিশকাত হা/৩৪২; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮; ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭।)


উল্লেখ্য যে, আবূদাঊদ ও নাসাঈতে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে, একদা রাসূল (ছাঃ) যে পাত্রের পানিতে ইস্তিঞ্জা করেন তার বিপরীত পাত্রে ওযূ করেন। (আবূদাঊদ হা/৪৫; নাসাঈ হা/৯৪; মিশকাত হা/৩৬০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৩৩, ২/৬৬ পৃঃ, পেশাব-পায়খানার শিষ্টাচার অনুচ্ছেদ।)

মূলতঃ পাত্রের পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলেই অন্য পাত্র তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। মুহাদ্দিছগণ এমনটিই বলেছেন। (ليس المعنى أنه لا يجوز التوضىء بالماء الباقي من الاستنجاء أو بالإناء الذي استنجى به وإنما أتى بإناء آخر لأنه لم يبق من الأول شيء أو بقي قليل والإتيان بالإناء الآخر اتفاقي كان فيه الماء فأتى به  -আল্লামা মুহাম্মাদ শামসুল হক আযীমাবাদী, আওনুল মাবূদ শরহে সুনানে আবী দাঊদ (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১৪১৫ হিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৫।)


(৯) পেশাব-পায়খানা থেকে বের হওয়ার পর আল-হামদুলিল্লা-হিল্লাযি আযহাবা আন্নিল আযা ওয়া আফানী দুআ পাঠ করা:
টয়লেট সারার পর বলবে,
গুফরা-নাকা। যা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। (ছহীহ আবূদাঊদ হা/৩০, ১/৫; তিরমিযী হা/৭, ১/৭।) আল-হামদুলিল্লা-হিল্লাযি.. মর্মে বর্ণিত হাদীছ যঈফ।


عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَرَجَ مِنْ الْخَلَاءِ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنِّي الْأَذَى وَعَافَانِي.
আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন পায়খানা থেকে বের হ
তেন তখন তিনি বলতেন, ঐ আল্লাহর যাবতীয় প্রশংসা যিনি আমার কষ্ট দূর করেছেন ও আমাকে সুস্থ করেছেন। (ইবনু মাজাহ হা/৩০১, পৃঃ ২৬; মিশকাত হা/৩৭৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৪৫, ২/৭০ পৃঃ; বঙ্গানুবাদ সুনানু ইবনে মাজাহ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ: ডিসেম্বর ২০০৫), হা/৩০১, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৪৯-১৫০।)


তাহক্বীক্ব: উক্ত বর্ণনার সনদে ইসমাঈল ইবনু মুসলিম নামে একজন রাবী আছে সে মুহাদ্দিছগণের ঐকমত্যে যঈফ। (যঈফ ইবনু মাজাহ হা/৩০১।)


(১০) ওযূর শুরুতে মুখে নিয়ত বলা:
মুখে নিয়ত বলার শারঈ কোন বিধান নেই। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি মানুষের তৈরী বিধান। অতএব তা পরিত্যাগ করতে হবে। বরং মনে মনে নিয়ত করতে হবে। (ছহীহ বুখারী হা/১; ছহীহ মুসলিম হা/৫০৩৬।) উল্লেখ্য যে, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)-এর নামে প্রকাশিত
পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল নামক বইয়ে বলা হয়েছে যে, ক্বিবলার দিকে মুখ করে উঁচু স্থানে বসে ওযূ করতে হবে। অথচ উক্ত কথার প্রমাণে কোন দলীল পেশ করা হয়নি। (হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ), পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা ও জরুরী মাসআলা মাসায়েল, সংকলনে ও সম্পাদনায়- মাওলানা আজিজুল হক (ঢাকা: মীনা বুক হাউস, ৪৫, বাংলা বাজার, চতুর্থ মুদ্রণ-আগস্ট ২০০৯), পৃঃ ৪২; উল্লেখ্য যে, মাওলানার নামে বহু রকমের ছালাত শিক্ষা বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে চালু আছে। কোনটি যে আসল অনুবাদ তা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।) উক্ত দাবী ভিত্তিহীন।


(১১) ওযূর শুরুতে বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রাহীম আল-ইসলামু হাক্কুন, ওয়াল কুফরু বাতিলুন, আল-ঈমানু নূরুন ওয়াল কুফরু যুলমাতুন দুআ পাঠ করা:
উক্ত দো
আর প্রমাণে কোন ছহীহ দলীল নেই। যদিওবা মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) উক্ত দোআর সাথে আরো কিছু বাড়তি কথা যোগ করে তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোন প্রমাণ উল্লেখ করেননি। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪৩।) এটা পড়লে সুন্নাতের বিরোধিতা করা হবে। উক্ত দোআটি দেশের বিভিন্ন মসজিদের ওযূখানায় লেখা দেখা যায়। উক্ত দোআ হতে বিরত থাকতে হবে। বরং ওযূর শুরুতে শুধু বিসমিল্লাহ বলতে হবে। (ছহীহ তিরমিযী হা/২৫, ১/১৩ পৃঃ; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩৯৭, পৃঃ ৩২, সনদ হাসান।)


(১২) প্রতিটি অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দোআ পড়া:
ওযূর প্রত্যেক অঙ্গ ধৌত করার সময় পৃথক পৃথক দু
আ পড়তে হবে মর্মে আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন। এর পক্ষেও তিনি কোন দলীল তিনি পেশ করেননি। তবে অন্য শব্দে একটি জাল হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন- 
يا أنس ادن مني أعلمك مقادير الوضوء فدنوت فلما أن غسل يديه قال بسم الله والحمد لله ولا حول ولا قوة إلا بالله فلما استنجى قال اللهم حصن فرجي ويسر لي أمري فلما توضأ واستنشق قال اللهم لقني حجتي ولا تحرمني رائحة الجنة فلما غسل وجهه قال اللهم بيض وجهي يوم تبيض وجوه فلما أن غسل ذراعيه قال اللهم أعطني كتابي بيميني فلما أن مسح يده على رأسه قال اللهم أغثنا برحمتك وجنبنا عذابك فلما أن غسل قدميه قال اللهم ثبت قدمي يوم تزل فيه الأقدام ثم قال والذي بعثني بالحق يا أنس ما من عبد قالها عند وضوئه لم تقطر من خلل أصابعه قطرة إلا خلق الله تعالى ملكا يسبح الله بسبعين لسانا يكون ثواب ذلك التسبيح إلى يوم القيامة.
(রাসূল (ছাঃ) বলেন) হে আনাস! তুমি আমার নিকটবর্তী হও তোমাকে ওযূর মিকদার শিক্ষা দিব। অতঃপর আমি তার নিকটবর্তী হ
লাম। তখন তিনি তাঁর দুই হাত ধৌত করার সময় বললেন, বিসমিল্লা-হি ওয়াল হামদুল্লিা-হি ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হি। যখন তিনি ইস্তিঞ্জা করলেন তখন বললেন, আল্লা-হুম্মা হাছি্ছন ফারজী ওয়া ইয়াসি্সরলী আমরী। যখন তিনি ওযূ করেন ও নাক ঝাড়েন তখন বলেন, আল্লা-হুম্মা লাক্কিনী হুজ্জাতী ওয়ালা তারহামনী রায়েহাতাল জান্নাতি। যখন তার মুখমন্ডল ধৌত করেন তখন বললেন, আল্লা-হুম্মা বাইয়িয ওয়াজহী ইয়াওমা তাবইয়ায্যু উজূহুওঁ। যখন তিনি দুই হাত ধৌত করলেন তখন বললেন, আল্লাহুম্মা আত্বিনী কিতাবী ইয়ামানী। যখন হাত দ্বারা মাসাহ করলেন তখন বললেন, আল্লা-হুম্মা আগিছনা বিরহমাতিকা ওয়া জান্নিবনা আযাবাকা। যখন তিনি দুই পা ধৌত করলেন তখন বললেন, আল্ল-হুম্মা ছাবিবত ক্বাদামী ইয়াওমা তাযিল্লু ফীহি আক্বদাম


অতঃপর তিনি বলেন, হে আনাস! ঐ সত্তার কসম করে বলছি যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, যে বান্দা ওযূ করার সময় এই দুআ বলবে তার আঙ্গুল সমূহের ফাঁক থেকে যত ফোঁটা পানি পড়বে তার প্রত্যেক ফোঁটা দ্বারা আল্লাহ তাআলা একজন করে ফেরেশতা তৈরি করবেন। সেই ফেরেশতা সত্তরটি জিহবা দ্বারা আল্লাহর তাসবীহ বর্ণনা করবেন। এই ছওয়াব ক্বিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। (তাযকিরাতুল মাওযূআত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, পৃঃ ১৩, পবিত্রতা অধ্যায়, হা/৩৩।)


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে উবাদা বিন ছুহাইব ও আহমাদ বিন হাশেমসহ কয়েকজন মিথ্যুক রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুৎনীসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে পরিত্যক্ত বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, এই বর্ণনাটি বাতিল, এর কোন ভিত্তি নেই। (فِيْهِ عُبَادَةُ بْنُ صُهَيْبٍ مُتَّهِمٌ وَقَالَ الْبُخَارِيُّ وَالنَّسَائِيُّ مَتْرُوْكٌ وفيه أحمد بن هاشم اتهمه الدارقطني وقد نص النووي بِبُطْلاَنِ هَذَا الْحَدِيْثِ وَأَنَّهُ لاَ أَصْلَ لَهُ  -তাযকিরাতুল মাওযূআত, পৃঃ ৩২; আল-ফাওয়াইদুল মাজমূআহ, পৃঃ ১৩, পবিত্রতা অধ্যায়, হা/৩৩।)
 

(১৩) ওযূর পানি পাত্রের মধ্যে পড়লে উক্ত পানি দ্বারা ওযূ হবে না বলে বিশ্বাস করা:
এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) লিখেছেন,
উঁচু স্থানে বসবে যেন ওযূর পানির ছিটা শরীরে আসতে না পারে।(পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২।) অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাত্রের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিতেন আবার বের করতেন এভাবে তিনি ওযূ করতেন। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮; ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭।)


(১৪) ত্রুটিপূর্ণ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায়। ওযূর সময় কথা বললে ফেরেশতারা রুমাল নিয়ে চলে যায়:
ওযূকারীর মাথার উপর চারজন ফেরেশতা রুমাল নিয়ে ছায়া করে রাখে। পর পর চারটি কথা বললে রুমাল নিয়ে চলে যায় বলে যে কাহিনী সমাজে প্রচলিত আছে তা উদ্ভট, মিথ্যা ও কাল্পনিক। তাছাড়া খারাপ কথা বললে ওযূ নষ্ট হয়ে যায় এ আক্বীদাও ঠিক নয়। এ মর্মে যে হাদীছ রয়েছে তা জাল। (আব্দুর রহমান ইবনু আলী ইবনিল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ ফিল আহাদীছিল ওয়াহিয়াহ (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪০৩), হা/৬০৪; দায়লামী ২/১৬০, হা/২৮১৪; ইমাম সুয়ূত্বী, জামিউল আহাদীছ হা/১১৭২৬।)


عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْحَدَثُ ১৭وَحَدَثُ الْفَرْجِ وَلَيْسَا سَوَاءً حَدَثُ اللِّسَانِ أَشَدٌَ مِنْ حَدَثِ الْفَرْجِ وَفِيْهَا الْوُضُوْءُ.
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, অপবিত্রতা দুই প্রকার। জিহবার ও লজ্জাস্থানের অপবিত্রতা। দুইটি এক রকম নয়। লজ্জাস্থানের অপবিত্রতার চেয়ে জিহবার অপবিত্র বেশি। আর এর কারণে ওযূ করতে হবে। (জাওয়াযকানী, আল-আবাতিল ১/৩৫৩ পৃঃ।)


তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। (আল-ইলালুল মুতানাহিয়াহ হা/৬০৪-এর আলোচনা দ্রঃ।) এর সনদে বাক্বিয়াহ নামক রাবী রয়েছে, সে ত্রুটিপূর্ণ। সে দুর্বল রাবীদের নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনাকারী। রাসূল (ছাঃ) থেকে উক্ত মর্মে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়নি। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, ছহীহ বুখারী হা/১৯১, ১/৩১ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮, ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪ ও ৪১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭।)


(১৫) কুলি করার জন্য আলাদা পানি নেওয়া:
সুন্নাত হল হাতে পানি নিয়ে একই সঙ্গে মুখে ও নাকে পানি দিবে। রাসূল (ছাঃ) এভাবেই ওযূ করতেন। যেমন-
مَضْمَضَ وَاسْتَنْشَقَ مِنْ كَفَّةٍ وَاحِدَةٍ.
তিনি এক অঞ্জলি দ্বারাই কুলি করেন ও নাক পরিষ্কার করেন।( আবূদাঊদ হা/১৩৯, ১/১৮-১৯ পৃঃ; বুলূগুল মারাম হা/৪৯, পৃঃ ১৮।)

আলাদাভাবে পানি নেওয়ার যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
عَنْ طَلْحَةَ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ دَخَلْتُ يَعْنِى عَلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَتَوَضَّأُ وَالْمَاءُ يَسِيْلُ مِنْ وَجْهِهِ وَلِحْيَتِهِ عَلَى صَدْرِهِ فَرَأَيْتُهُ يَفْصِلُ بَيْنَ الْمَضْمَضَةِ وَالاِسْتِنْشَاقِ.
তালহা (রাঃ) তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি ওযূ করছিলেন। আর পানি তাঁর মুখমন্ডল ও দাড়ি থেকে তাঁর বুকে পড়ছিল। অতঃপর আমি তাকে দেখলাম তিনি কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার সময় পৃথক করলেন।


তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে লাইছ ও মুছাররফ নামের দুজন রাবী রয়েছে, যারা ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়াও আরো ত্রুটি রয়েছে। এই হাদীছ যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ একমত। (শরহে বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৬।) শায়খ ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, তালক বিন মুছাররফের হাদীছ পৃথক করা প্রমাণ করে, কিন্তু তা যঈফ। (তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪।)


(১৬) কান মাসাহ করার সময় নতুন পানি নেওয়া:
ওযূতে কান মাসাহ করার ক্ষেত্রে মাথা ও কান একই সঙ্গে একই পানিতে মাসাহ করবে। কান মাসাহ করার জন্য পৃথকভাবে নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত।(বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬।) বায়হাক্বীতে একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করার ছহীহ হাদীছ এসেছে। (বায়হাক্বী, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আছার হা/১৯১, ১/২২৯ পৃঃ; বলূগুল মারাম হা/৩৯, পৃঃ ২৩।) নতুনভাবে পানি নেওয়ার হাদীছটি ছহীহ নয়।


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَيْدٍ أَنَّهُ رَأَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْخُذُ لِأُذُنَيْهِ مَاءً غَيْرَ الْمَاءِ الَّذِي أَخَذَهُ لِرَأْسِهِ.
আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) হ
তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছেন যে, পানি দ্বারা মাথা মাসাহ করেছেন। অতঃপর তা ব্যতীত কান মাসাহ করার জন্য পৃথক পানি নিয়েছেন। (ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ।)


তাহক্বীক্ব: উক্ত শব্দে বর্ণিত হাদীছ যঈফ। উল্লেখ্য যে, উক্ত বর্ণনার পরে হাদীছটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী ও বায়হাক্বীর যে মন্তব্য ইবনু হাজার আসক্বালানী তুলে ধরেছেন তা মূলতঃ এই হাদীছের ক্ষেত্রে নয়; বরং হাত ধৌত করার পর নতুন করে পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীছটির ব্যাপারে, যা ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১/১২২ পৃঃ, হা/২৮-এর আলোচনা; বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/১০৪৬ ও ৯৯৫; মাজমূউ ফাতাওয়া আলবানী, পৃঃ ৩৬।)

তাই আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,
قُلْتُ لَمْ أَقِفْ عَلَى حَدِيْثٍ مَرْفُوْعٍ صَحِيْحٍ خَالٍ عَنِ الْكَلاَمِ يَدُلُّ عَلَى مَسْحِ الْأُذُنَيْنِ لِمَاءٍ جَدِيْدٍ.
আমি বলছি, সমালোচনা থেকে মুক্ত এমন কোন মারফূ হাদীছ এ ব্যাপারে আছে বলে আমি অবগত নই, যার দ্বারা নতুন পানি নিয়ে কান মাসাহ করা যাবে।(বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩১৪; মুওয়াত্ত্ব হা/৯২।)


عَنْ نَافِعٍ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ إِذَا تَوَضَّأَ يَأْخُذُ الْمَاءَ بِإِصْبَعَيْهِ لأُذُنَيْهِ.
নাফে
বলেন, ইবনু ওমর (রাঃ) যখন ওযূ করতেন তখন কান মাসাহ করার জন্য দুই আঙ্গুলে পানি নিতেন। (وأما ما روي عن النبي صلى الله عليه و سلم أنه قال الأذنان من الرأس فروى ذلك بأسانيد ضعاف -ঐ, বায়হাক্বী হা/৩১৭-এর ভাষ্য দ্রঃ।)


তাহক্বীক্ব: এ বর্ণনাটিও যঈফ। বায়হাক্বীর মুহাক্কিক মুহাম্মাদ আব্দুল ক্বাদির আতা বলেন, রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ঐ হাদীছগুলো যঈফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। (ইমাম শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ১/২০০ পৃঃ; বুলূগুল মারাম, পৃঃ ২৩-এর উক্ত হাদীছের ভাষ্য দ্রঃ।)


উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর ব্যক্তিগত আমলকে ইবনুল ক্বাইয়িম ছহীহ হওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু উক্ত ত্রুটি থাকার কারণে তা যঈফ। যেমন তিনি বলেন, لَمْ يَثْبُتْ عَنْهُ أَنَّهُ أَخَذَ لَهُمَا مَاءً جَدِيْدًا وَإِنَّمَا صَحَّ ذَلِكَ عَنْ عُمَرَ. রাসূল (ছাঃ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি যে তিনি দুই কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নিয়েছেন। তবে ইবনু ওমর থেকে সেটা ছহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।(সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬-এর ভাষ্য দ্রঃ।)

শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,  لاَ حَاجَةَ لأَِخْذِ مَاءٍ جَدِيْدٍ مُنْفَرِدٍ لِمَسْحِ الْأُذُنَيْنِ غَيْرَ مَاءِ الرَّأْسِ بَلْ يَجْزِِيْ مَسْحُهُمَا بِبَلَلِ مَاءِ الرَّأْسِ.  ‘দুই কান এককভাবে মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং মাথার জন্য ভিজা পানি দ্বারাই দুই কান মাসাহ করা জায়েয।(তিরমিযী হা/৩৭, ১/১৬ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৪৪৩ ও ৪৪৪, পৃঃ ৩৫, সনদ ছহীহ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬; ইরওয়াউল গালীল হা/৮৪।)
অতএব কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি নেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং মাথা ও কান একই সঙ্গে মাসাহ করতে হবে।


জ্ঞাতব্য: অনেকে কান মাসাহকে ফরয বলেন না। অথচ কানসহ  মাথা  মাসাহ  করা  ফরয।  কারণ  দুই  কান মাথার অন্তর্ভুক্ত।  রাসূল (ছাঃ) বলেন,  ‘দুই কান মাথার অন্তর্ভুক্ত।(ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৩৭; বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২৫৬; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা হা/১৬১, সনদ ছহীহ।)

তাছাড়া রাসূল (ছাঃ) একই পানিতে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন-  ثُمَّ غَرَفَ غَرْفَةً فَمَسَحَ رَأْسَهُ وَأُذُنَيْهِ. অতঃপর তিনি এক অঞ্জলি পানি নিতেন এবং মাথা ও দুই কান মাসাহ করতেন।(পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২।)


(১৭) মাথা ও কান মাসাহ করার জন্য নতুন পানি না নেওয়া:
অনেকে দুই হাত ধৌত করার পর সরাসরি মাথা মাসাহ করেন, নতুন পানি নেন না। যেমন আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেছেন,
কান ও মাথা মাছহে করার জন্য নতুন পানি নেয়ার প্রয়োজন নেই, ভেজা হাত দ্বারাই মাছহে করবে।(ছহীহ মুসলিম হা/৫৮২, ১/১২৩ পৃঃ, নবী (ছাঃ)-এর ওযূ অনুচ্ছেদ।) এটি সুন্নাতের বরখেলাফ। কারণ রাসূল (ছাঃ) দুই হাত ধৌত করার পর নতুন পানি নিয়ে মাথা ও কান মাসাহ করতেন। যেমন- مَسَحَ بِرَأْسِهِ بِمَاءٍ غَيْرِ فَضْلِ يَدِهِ হাতের অতিরিক্ত পানি ছাড়াই তিনি নতুন পানি দ্বারা তাঁর মাথা মাসাহ করতেন।( দ্রঃ ছহীহ মুসলিম হা/৬৪৭, ১/১৩৩ পৃঃ ও হা/৬৫৬, ১/১৩৪ পৃঃ।)


(১৮) মাথার এক-চতুর্থাংশ মাসাহ করা:
মাথা মাসাহ করার ব্যাপারে অবহেলা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ চুল স্পর্শ করাকেই মাসাহ মনে করেন, কেউ মাথার চার ভাগের একভাগ মাসাহ করেন এবং কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় নেমে পড়েন। কুদূরী ও
  হেদায়ার লেখক চার ভাগের এক ভাগ মাসাহ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আর দলীল হিসাবে পেশ করেছেন ছহীহ মুসলিমের হাদীছ। অথচ উক্ত হাদীছে পাগড়ী থাকা অবস্থায় মাসাহ করা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কুদূরী  এবং হেদায়াতে মুগীরা (রা)-এর নামে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা ভুল হয়েছে। (আবুল হাসান বিন আহমাদ বিন জাফর আল-বাগদাদী আল-কুদূরী, মুখতাছারুল কুদূরী (ঢাকা: ইসলামিয়া কুতুবখানা, বাংলাবাজার ১৯৮২/১৪০৩), পৃঃ ৩; শায়খুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনু আবী বকর আল-মারগীনানী (৫১১-৫৯৩ হিঃ), আল-হেদায়াহ (নাদিয়াতুল কুরআন কুতুবখানা (১৪০১), ১/১৭ পৃঃ; বঙ্গানুবাদ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ মার্চ ২০০৬), ১/৬ পৃঃ।) যা হেদায়ার টীকাতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। তারা দুইটি হাদীছকে একত্রে মিশ্রিত করে উল্লেখ করেছেন। (ছহীহ বুখারী হা/১৮৫, ১/৩১ পৃঃ; বুখারী (ইফাবা) হা/১৮৫;  মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৯৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২/৭৮ পৃঃ; ছহীহ তিরমিযী হা/৩৪।)


সুধী পাঠক! শরীআতের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীছে রাসূল (ছাঃ) সুন্দরভাবে মাথা মাসাহ করার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। কারণ পবিত্র কুরআন তাঁর উপরই নাযিল হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) মাথার সামনের দিক থেকে শুরু করে পিছনে চুলের শেষ পর্যন্ত দুই হাত নিয়ে যেতেন এবং সেখান থেকে সামনে নিয়ে এসে শেষ করতেন। এভাবে তিনি পুরো মাথা মাসাহ করতেন। যেমন-

ثُمَّ مَسَحَ رَأْسَهُ بِيَدَيْهِ فَأَقْبَلَ بِهِمَا وَأَدْبَرَ بَدَأَ بِمُقَدَّمِ رَأْسِهِ حَتَّى ذَهَبَ بِهِمَا إِلَى قَفَاهُ ثُمَّ رَدَّهُمَا إِلَى الْمَكَانِ الَّذِي بَدَأَ مِنْهُ.
অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাত দ্বারা মাথা মাসাহ করেন। এতে দুই হাত তিনি সামনে করেন এবং পিছনে নেন। তিনি মাথার অগ্রভাগ থেকে শুরু করে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যেতেন অতঃপর যে স্থান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।(ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মাআদ ১/১৮৫ পৃঃ, মাসাহ করার বর্ণনা)


ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৪১ হিঃ) বলেন,
وَلَمْ يَصِحّ عَنْهُ فِي حَدِيثٍ وَاحِدٍ أَنّهُ اقْتَصَرَ عَلَى مَسْحِ بَعْضِ رَأْسِهِ الْبَتّةَ.
রাসূল (ছাঃ) কখনো মাথার কিছু অংশ মাসাহ করেছেন মর্মে কোন একটি হাদীছ থেকেও প্রমাণিত হয়নি।(ছহীহ মুসলিম হা/৬৫৬, ৫৭, ৫৯, ১/১৩৪ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬৭, ২/৮১ পৃঃ; ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মাআদ ১/১৮৫ পৃঃ, মাসাহ করার বর্ণনা)


উল্লেখ্য, পাগড়ী পরা অবস্থায় থাকলে মাথার অগ্রভাগ মাসাহ করা যাবে। (যঈফ আবূদাঊদ হা/১৪৭; যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৫৬৪।) আরো উল্লেখ্য যে, পাগড়ীর নীচে মাসাহ করতেন বলে যে হাদীছ আবূদাঊদে বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ। (পূর্ণাঙ্গ নামায শিক্ষা, পৃঃ ৪২ ও ৪৪।)

(১৯) ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা:
ওযূতে ঘাড় মাসাহ করার পক্ষে ছহীহ কোন প্রমাণ নেই। এর পক্ষে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সবই জাল ও মিথ্যা। অথচ আলেমগণ এর পক্ষে মুসলিম জনতাকে উৎসাহিত করেছেন। আশরাফ আলী থানবী ঘাড় মাসাহ করার দাবী করেছেন এবং এ সময় পৃথক দো
আ পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। (ঐ, (ঢাকা: মুমতায লাইব্রেরী, ১১, বাংলাবাজার, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০১০), পৃঃ ১১৪-১১৫।) ড. শাইখ মুহাম্মাদ ইলিয়াস ফয়সাল (মদীনা মুনাওয়ারাহ) প্রণীত ও মারকাযুদ-দাওয়াহ আল-ইসলামিইয়াহ, ঢাকার শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ অনুদিত নবীযীর নামায বইয়ে ওযূর সুন্নাত আলোচনা করতে গিয়ে গর্দান মাসাহ করার কথা বলেছেন। এর পক্ষে জাল হাদীছও পেশ করেছেন। (তাবারাণী কবীর হা/১৭৫৮৪, ২২/৫০।) এভাবেই ভিত্তিহীন আমলটি সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। জাল দলীলগুলো নিম্নরূপ:


(1)
عَنْ وَائِلِ بن حُجْرٍ... فِىْ صِفَةِ وَضُوْءِ النَّبِىِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ثُمَّ مَسَحَ عَلَى رَأْسِهِ ثَلاثًا وَمَسَحَ ظَاهَرَ أُذُنَيْهِ وَمَسَحَ رُقْبَتَهُ وَبَاطِنَ لِحْيَتِهِ بِفَضْلِ مَاءِ الرَّأْسِ...
(এক) ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর ওযূর পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করেন। ..অতঃপর তিনি তিনবার তার মাথা মাসাহ করেন এবং দুই কানের পিঠ মাসাহ করেন ও ঘাড় মাসাহ করেন, দাড়ির পেট মাসাহ করেন মাথার অতিরিক্ত পানি দিয়ে। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯ ও ৭৪৪।)


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। (আল-মাজমূ শারহুল মুহযযাব ১/৪৬৫ পৃঃ।) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,
 هَذَا مَوْضُوْعٌ لَيْسَ مِنْ كَلاَمِ النَّبِىِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
এটা জাল। নবী (ছাঃ)-এর বক্তব্য নয়। (তাবারাণী কবীর ১৯/১৮১।)

 
(২)
عَنْ عَمْرِو بْنِ كَعْبٍ قال رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ َسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ بَاطِنَ لِحْيَتِهِ وَقَفَاهُ.
(দুই) আমর ইবনু কা
ব বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ওযূ করার সময় আমি দাড়ির পেট এবং ঘাড় মাসাহ করতে দেখেছি। (লিসানুল মীযান ৬/৪২ পৃঃ; তানক্বীহ, পৃঃ ৮৩।)


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। ইবনুল ক্বাত্ত্বান বলেন, এর সনদ অপরিচিত। মুছাররফসহ তার পিতা ও দাদা সবাই অপরিচিত। (আবূদাঊদ হা/১৩২, ১/১৭-১৮ পৃঃ।)

(3)
عَنْ طَلْحَةَ بْنِ مُصَرِّفٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ َسَلَّمَ يَمْسَحُ رَأْسَهُ مَرَّةً وَاحِدَةً حَتَّى بَلَغَ الْقَذَالَ وَهُوَ أَوَّلُ الْقَفَا.
(তিন) তালহা ইবনু মুছাররফ তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি তিনি একবার তাঁর মাথা মাসাহ করতেন এমনকি তিনি মাথার পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত পৌঁছাতেন। আর তা হ
ল ঘাড়ের অগ্রভাগ। (وَمَسَحَ رَأْسَهُ مِنْ مُقَدَّمِهِ إِلَى مُؤَخَّرِهِ حَتَّى أَخْرَجَ يَدَيْهِ مِنْ تَحْتِ أُذُنَيْهِ. قَالَ مُسَدَّدٌ فَحَدَّثْتُ بِهِ يَحْيَى فَأَنْكَرَهُ. قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَسَمِعْتُ أَحْمَدَ يَقُولُ ابْنُ عُيَيْنَةَ زَعَمُوا كَانَ يُنْكِرُهُ وَيَقُولُ أَيْشِ هَذَا طَلْحَةُ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ؟ -যঈফ আবুদাঊদ হা/১৩২-এর আলোচনা দ্রঃ।)


তাহক্বীক্ব: হাদীছটি মুনকার বা অস্বীকৃত। মুসাদ্দাদ বলেন, তিনি মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিক পর্যন্ত মাসাহ করেন এমনকি তার দুই হাত কানের নিচ দিয়ে বের করে নেন
এই কথা ইয়াহইয়ার কাছে বর্ণনা করলে তিনি একে অস্বীকৃতি জানান। ইমাম আবূদাঊদ বলেন, আমি ইমাম আহমাদকে বলতে শুনেছি, ইবনু উআইনাহ বলতেন, মুহাদ্দিছগণ ধারণা করতেন এটা ছহীহ হাদীছের বিরোধী। তিনি এটাও বলতেন, তালহা তার পিতার সূত্রে তার দাদা থেকে এ কথা কোথায় পেল? (সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৯, ১/১৬৮ পৃঃ।)


(4)
مَسْحُ الرُّقْبَةِ أَمَانٌ مِنَ الْغِلِّ.
(চার)
ঘাড় মাসাহ করলে বেড়ী থেকে নিরাপদ থাকবে


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। (হাফেয জালালুদ্দীন আস-সুয়ূত্বী, আল-লাআলিল মাছনূআহ ফিল আহাদীছিল মাওযূআহ, পৃঃ ২০৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৮ পৃঃ।) ইমাম সুয়ূত্বী জাল হাদীছের গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। (আবু নুআইম, তারীখুল আছবাহান ২/১১৫ পৃঃ।)

(5)
مَنْ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عُنُقَهُ لَمْ يَغِلُّ بِالأَغْلاَلِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
(পাঁচ)
যে ব্যক্তি ওযূ করবে এবং ঘাড় মাসাহ করবে তাকে ক্বিয়ামতের দিন বেড়ী দ্বারা বেড়ী পরানো হবে না।(সিলসিলা যঈফাহ হা/৭৪৪, ২/১৬৭ পৃঃ।)


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। (আল-মাছনূ ফী মারেফাতুল হাদীছিল মাওযূ, পৃঃ ৭৩, দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী উক্ত বর্ণনাকে জাল বলেছেন। (সিলসিলা যঈফাহ ১/১৬৯ পৃঃ।) উক্ত বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু আমল আল-আনছারী ও মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইবনে মুহাররম নামের দুজন রাবী ত্রুটিপূর্ণ। মুহাদ্দিছগণ তাদেরকে দুর্বল বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। (বায়হাক্বী, সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৬৮; আওনুল মাবুদ ১/৪১৭-১৮ পৃঃ।)


ঘাড় মাসাহ করা সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা আরো আছে। এর দ্বারা প্রতারিত হওয়া যাবে না। বরং ঘাড় মাসাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে।


(২০) ওযূর পর অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা:
ওযূ করার পর রুমাল, গামছা কিংবা কাপড় দ্বারা অঙ্গ মুছতে পারে। এটা ইচ্ছাধীন। (ইবনু শাহীন, নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫, দ্রঃ যাকারিয়া বিন গুলামা ক্বাদের পাকিস্তানী, তানক্বীহুল কালাম ফিল আহাদীছিয যঈফাহ ফী মাসাইলিল আহকাম (বৈরুত: দারু ইবনে হাযম, ১৯৯৯/১৪২০), পৃঃ ৯৬।) যে বর্ণনায় অঙ্গ মুছতে নিষেধ করা হয়েছে তা জাল বা মিথ্যা।


  عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ َسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يَمْسَحُ وَجْهَهُ بِالْمِنْدِيْلِ بَعْدَ الْوَضُوْءِ وَلاَ أَبُوْ بَكْرٍ وَلاَ عُمَرُ وَلاَ عَلِىٌّ وَلاَ ابْنُ مَسْعُوْدٍ.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর, ওমর, আলী এবং ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ওযূর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছতেন না। (আওনুল মা
বূদ ১/২৮৭ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ১/২২০ পৃঃ; নাসিখুল হাদীছ ওয়া মানসূখাহু, পৃঃ ১৪৫।)


তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। এর সনদে সাঈদ বিন মাইসারা নামে একজন রাবী রয়েছে। ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাকে মিথ্যুক বলেছেন। ইবনু হিববান তাকে জাল হাদীছের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বলেছেন। (لو صحت هذه الجملة لكانت نصا على استحباب إطالة الغرة و التحجيل لا على إطالة العضد -আলবানী, সিলসিলা  ছহীহাহ হা/২৫২ নং-এর ভাষ্য দ্রঃ, উল্লেখ্য, উক্ত অংশটুকু সংযোজনের ক্ষেত্রে ত্রুটি সাব্যস্ত হয়েছে বলেও মুহাদ্দিছগণ উল্লেখ করেছেন। -দ্রষ্টব্য আহমাদ হা/৮৩৯৪; ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী হা/১৩৬-এর আলোচনা, ওযূর ফযীলত অনুচ্ছেদ; ইরওয়াউল গালীল ১/১৩৩ পৃঃ।) উল্লেখ্য, উক্ত মর্মে যঈফ হাদীছও আছে।


(২১) হাত ধোয়ার সময় কনুই-এর উপরে আরো বেশী করে বাড়িয়ে ধৌত করা: হাত ধৌত করতে হবে কুনই পর্যন্ত। এর বেশি নয়। আল্লাহর নির্দেশ এটাই (সূরা মায়েদাহ ৬)। হাদীছের শেষে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করার যে বক্তব্য এসেছে তার উদ্দেশ্য অঙ্গ বাড়িয়ে ধৌত করা নয়; বরং ভালভাবে ওযূ সম্পাদন করা। (ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৫৯; ছহীহ তিরমিযী হা/৯৯; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫২৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৮, ২/১৩২ পৃঃ।)


(২২) চামড়ার মোজা ছাড়া মাসাহ করা যাবে না বলে ধারণা করা: উক্ত ধারণা সঠিক নয়। বরং যেকোন পবিত্র মোজার উপর মাসাহ করা যাবে। (আলোচনা দ্রঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া ১/২৬২ পৃঃ; আলবানী, আছ-ছামারুল মাস্তাত্বাব, পৃঃ ১৪-১৫।) হাদীছে কোন নির্দিষ্ট মোজার শর্তারোপ করা হয়নি।
(চলবে.)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন