আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত
আক্বীদা
(২য় কিস্তি)
আল্লাহ
সর্বত্র বিরাজমান নন : যুক্তির নিরিখে ইতিপূর্বে পেশকৃত দলীলভিত্তিক আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নন। এ বিষয়ে নিম্নে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা পেশ করা হ’ল-
(১) মানুষ যখন ছালাতের মধ্যে সিজদাবনত থাকে তখন তার মন-প্রাণ কোথায় যায়? অবশ্যই উপরের দিকে; নীচের দিকে নয়।
(২) মানুষ যখন দু’হাত উত্তোলন করে দো‘আ করে, তখন কেন উপরের দিকে হাত উত্তোলন করে? এক্ষেত্রে মানুষের বিবেক বলবে, আল্লাহ উপরেই আছেন; সর্বত্র নন।
(৩) মানুষ যখন টয়লেটে যায়, তখন কি সাথে মহান আল্লাহ থাকেন? আল্লাহর শানে এমন কথা বলা চরম ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়।
(৪) মানুষ যেমন তার নির্মিত বাড়ী সম্পর্কে সবই বলতে পারে যে, বাড়ীতে কয়টা ঘর আছে, কয়টা স্তম্ভ আছে। এক কথায় সবই তার জানা। তেমনি বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা আরশের উপর সমাসীন থেকে বিশ্ব জাহানের সব খবর রাখেন। আল্লাহ আরশের উপরে থাকলেও তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বব্যাপী।
(৫) মানুষ যেখানেই যায় সেখানেই চন্দ্র-সূর্য দেখতে পায়। মনে হয় সেগুলো তার সাথেই আছে। চন্দ্রটা বাংলাদেশ, ভারত, সঊদী সব জায়গা থেকে মানুষ দেখতে পায়। চন্দ্র আল্লাহরই সৃষ্টি, তাকে সব জায়গা থেকে মানুষ দেখতে পাচ্ছে। অথচ সেটা আসমানেই আছে। অনুরূপ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আরশের উপর থেকে সকল সৃষ্টির সব কাজ দেখাশুনা করেন- এটাই বিশ্বাস করতে হবে।
(৬) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,
‘যে বলবে যে,
আল্লাহ আসমানে আছেন, না যমীনে আছেন আমি তা জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে
যে, তিনি আরশে আছেন। কিন্তু আরশ আকাশে, না যমীনে অবস্থিত আমি তা জানি না। সেও কুফরী
করবে। কেননা উপরে থাকার জন্যই আল্লাহকে ডাকা হয়; নীচে থাকার জন্য নয়। আর নীচে থাকাটা
আল্লাহর রুবূবিয়্যাত এবং উলূহিয়্যাতের গুণের কিছুই নয়’।(ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আবসাত,
পৃঃ ৫১।) তাই আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলার আরশের উপর থাকাটাই শোভা পায়, নীচে নয়। কেননা আল্লাহ
সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, রিযিকদাতা, জীবন-মৃত্যু সব কিছুরই মালিক ও হক উপাস্য। তাঁর
জন্য সৃষ্টির গুণের কোন কিছুই শোভা পায় না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর সমাসীন; সর্বত্র বিরাজমান
নন।
আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান মর্মে কুরআনুল কারীমের যেসব আয়াত উল্লেখ করা হয় তার জবাব নিম্নে আলোচনা করা হ’ল :
(১) মহান আল্লাহ বলেন, ‘আকাশ ও যমীনে তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু জানেন এবং তোমরা যা অর্জন কর সেটাও তিনি অবগত আছেন’ (আন‘আম ৬/৩)।
(২) আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই ইলাহ নভোমন্ডলে, তিনিই ইলাহ ভূতলে এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ’ (যুখরুফ ৪৩/৮৪)।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় পেশ করে যারা আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান বলে দাবী
করেন, তাদের কথা বাতিল। কেননা আকাশে যত সৃষ্টি আছে তাদের সবার প্রভু, মা‘বূদ আল্লাহই। তারা সবাই আল্লাহর ইবাদত
করে। তেমনি যারা যমীনে আছে তাদের প্রভু ও মা‘বূদও একমাত্র আল্লাহ। তারাও সবাই ভয়-ভীতি সহকারে আল্লাহরই
ইবাদত করে।(তাফসীর ইবনে কাছীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭৪।)
(৩) মহান আল্লাহ বলেন,
‘তুমি কি লক্ষ্য কর না, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন? তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসাবে তিনি থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও এমন কোন গোপন পরামর্শ হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসাবে তিনি থাকেন না। তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ (জ্ঞানের দিক দিয়ে) তাদের সাথে আছেন। অতঃপর তারা যা করে, তিনি তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন তা জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত’ (মুজাদালাহ ৫৮/৭)।
এ আয়াত দ্বারা অনেকে যুক্তি পেশ করে বলেন যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান।
তাদের এ দাবী ভিত্তিহীন। কারণ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ আয়াতটি ইলম দ্বারাই শুরু
করেছেন এবং ইলম দ্বারাই শেষ করেছেন’।( তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/১২-১৩; ইমাম আহমাদ, আর-রাদ্দু
আলাল জাহমিয়্যাহ, পৃঃ ৪৯-৫১।)
এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের সাথে আছেন।
ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহর জ্ঞান
তাদের সঙ্গে’। তিনি আরো
বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর এবং তাঁর জ্ঞান তাদের
সব কিছু অবহিত’।(মাজমূঊ
ফাতাওয়া ৫/১৮৮-৮৯।)
(৪) আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান বলে অনেকে নিম্নের আয়াত পেশ করে যুক্তি দেয়- ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন- তিনি (জানার দিক দিয়ে) তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)।
ইয়াহ্ইয়া বিন ওছমান বলেন, ‘আমরা একথা বলব না, যেভাবে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায় বলে
যে, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, সবকিছুর সাথে মিশে আছেন এবং আমরা জানি না যে তিনি কোথায়;
বরং বলব আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং
আরশের উপর সমাসীন, আর তাঁর জ্ঞান, ক্ষমতা, দেখা-শুনা সবার সাথে। এটাই উক্ত আয়াতের অর্থ।
ইবনু তায়মিয়া বলেন, যারা ধারণা করে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাদের কথা বাতিল। বরং আল্লাহ
স্বয়ং আরশের উপরে সমাসীন এবং তাঁর জ্ঞান সর্বত্র রয়েছে।(মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/১৯১-৯৩।)
উক্ত আয়াতের (হাদীদ ৪) ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেছেন,
‘অর্থাৎ তিনি
তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের কার্যসমূহের সাক্ষী।
তোমরা ভূভাগে বা সমুদ্রে, রাতে বা দিনে, বাড়িতে বা বিজন মরুভূমিতে যেখানেই অবস্থান
কর না কেন সবকিছুই সমানভাবে তাঁর জ্ঞান এবং তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টির মধ্যে আছে। তিনি তোমাদের
কথা শোনেন, তোমার অবস্থান দেখেন এবং তোমাদের গোপন কথা ও পরামর্শ জানেন’।(তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ
৫৬০।)
উছমান বিন সাঈদ আর-দারেমী বলেন,
‘তিনি আরশের
উপরে থেকেই প্রত্যেক গোপন পরামর্শ ও প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে উপস্থিত
থাকেন। কেননা তাঁর জ্ঞান তাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছে এবং তাঁর দৃষ্টি তাঁদের মধ্যে ক্রিয়াশীল
আছে। তাঁর জ্ঞান ও দৃষ্টি থেকে কোন কিছুই আড়াল করতে পারে না এবং তারা তাঁর নিকট থেকে
কোন কিছুই গোপন করতে পারে
না। তিনি তাঁর পূর্ণ সত্তাসহ তাঁর সৃষ্টি থেকে দূরে আরশের উপরে সমাসীন আছেন। তিনি গোপন
ও সুপ্ত বিষয় জানেন (ত্ব-হা ৭)।
তিনি আরশের উপরে থেকেই তাদের কারো নিকট ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষা নিকটে অবস্থান করেন। তাঁর
জন্য এমনটি হওয়ার বিষয়ে তিনি সক্ষম। কারণ কোন কিছুই তাঁর থেকে দূরে নয় এবং আকাশমন্ডলী
ও যমীনের কোন কিছুই তাঁর নিকট গোপন থাকে না। তিনি গোপন পরামর্শের সময় চতুর্থ জন, পঞ্চম
জন ও ষষ্ঠজন হিসাবে আবির্ভূত হন। তবে তিনি স্বয়ং তাঁর সত্তাসহ তাদের সাথে পৃথিবীতে
বিরাজমান নন’।(উছমান বিন
সাঈদ আদ-দারেমী, আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ, তাহকীক : বদর বিন আব্দুল্লাহ বদর (কুয়েত
: দারু ইবনিল আছীর, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃঃ ৪৩-৪৪।)
(৫) ‘আমি তার ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষাও নিকটতর’ (ক্বাফ ৫০/১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৮৫)। যারা এ আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করে বলেন, আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান তাদের ধারণা ঠিক নয়।
এখানে উভয় আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতারা মানুষের নিকটবর্তী। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী’ (হিজর ৯)। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমে জিবরীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পবিত্র কুরআন পৌঁছে দিয়েছেন। অনুরূপভাবে ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমে ও তাঁর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মানুষের ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষা নিকটতর। আর মানুষের উপর ফেরেশতার যেমন প্রভাব থাকে, তেমনি শয়তানেরও।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
‘তোমাদের মধ্যে
এমন কেউ নেই যার সাথে তার জিন সহচর অথবা ফেরেশতা সহচর নিযুক্ত করে দেয়া হয়নি। ছাহাবীগণ
জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সাথেও কি হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, আমার সাথেও, তবে আল্লাহ
তা‘আলা তার ব্যাপারে
আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। সে আমাকে কেবল ভাল কাজেরই পরামর্শ
দেয়’।(মুসলিম,
মিশকাত হা/৬৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়।)
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান মানুষের মধ্যে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে’।(মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮
‘ঈমান’ অধ্যায়,
‘কুমন্ত্রণা’ অনুচ্ছেদ।)
এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘স্মরণ রেখো, দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে
বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর
প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (ক্বাফ ১৮)। আমরা যা কিছু বলি সবই
ফেরেশতারা লিপিবদ্ধ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই রয়েছে তোমাদের জন্য তত্ত্বাবধায়কগণ, সম্মানিত
লেখকবর্গ, তারা জানে তোমরা যা কর’।(
ইনফিতার ৮২/১০-১২; তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৪০৪।)
আল্লামা মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন, উভয় আয়াতে নিকটবর্তী বুঝাতে ফেরেশতাদের নিকটবর্তী হওয়া বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ এখানে উভয় আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফেরেশতাগণ।
(১) প্রথম আয়াতে (ক্বাফ ১৬) নিকটবর্তিতাকে শর্তযুক্ত (مقيد) করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,
‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর। স্মরণ রেখো, দুই গ্রহণকারী ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে; মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৬-১৮)। উল্লিখিত আয়াতে إِذْ يَتَلَقَّي শর্ত দ্বারা বুঝা যায় যে, দু’জন ফেরেশতার নিকটবর্তিতাই এখানে উদ্দেশ্য।
(২) দ্বিতীয় আয়াতে (ওয়াকি‘আহ ৮৫) নিকটবর্তিতাকে মৃত্যুকালীন সময়ের সাথে শর্তযুক্ত (مقيد) করা হয়েছে। আর মানুষের মৃত্যুর সময় যারা তার নিকট উপস্থিত থাকেন তারা হলেন ফেরেশতা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অবশেষে যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিত দূতগণ তার প্রাণ হরণ করে নেয় এবং তারা কোন ত্রুটি করে না’ (আন‘আম ৬/৬১)।
উল্লিখিত আয়াতে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা হচ্ছেন ফেরেশতা। তারা সেখানে
একই স্থানে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।( আল-কাওয়াইদুল মুছলা ফী ছিফাতিল্লাহি
ওয়া আসমায়িহিল হুসনা, পৃঃ ৭০-৭১।)
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, যদি আয়াত দু’টিতে ফেরেশতাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহ’লে আল্লাহ নিকটবর্তিতাকে নিজের দিকে
কেন সম্পর্কিত করলেন? এর জবাবে বলা যায় যে, ফেরেশতাদের নিকটবর্তিতাকে আল্লাহ নিজের
দিকে সম্পর্কিত করেছেন। কারণ তার নির্দেশেই তারা মানুষের নিকটবর্তী হয়েছে। আর তারা
তার সৈন্য ও দূত। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি উহা পাঠ করি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৮)। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট
জিবরীল (আঃ)-এর কুরআন পাঠ উদ্দেশ্য। অথচ আল্লাহ পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে যেহেতু জিবরীল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কুরআন পাঠ করেন সেহেতু আল্লাহ
কুরআন পাঠকে নিজের দিকে সম্পর্কিত করেছেন।( ঐ।)
আমরা কুরআন-হাদীছ থেকে এবং আলেমদের থেকে যা পাচ্ছি তা হ’ল আল্লাহ তা‘আলা আরশে সমাসীন; সর্বত্র বিরাজমান নন। কারণ কুরআন-হাদীছের সঠিক অর্থ না জানার কারণেই আমরা ভুল করে থাকি। তাই কুরআন-হাদীছের দলীল পাওয়ার পরেও যদি না বুঝার ভান করি তাহ’লে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন আমাদেরকে ছেড়ে দিবেন না।
(২) আল্লাহ কি নিরাকার?
আল্লাহ তা‘আলার আকার আছে, তিনি নিরাকার নন। নিরাকার অর্থ যা দেখে না, শুনে না। কিন্তু আল্লাহ সবকিছু দেখেন, শোনেন। তিনি এ বিশ্বজাহান ও সমস্ত সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও পরিচালক। তিনি মানুষকে রিযিক দান করেন, রোগাক্রান্ত করেন ও আরোগ্য দান করেন। সুতরাং তাঁর আকার নেই, একথা স্বীকার করা তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
আল্লাহ শুনেন, দেখেন, উপকার-ক্ষতি, কল্যাণ-অকল্যাণ বিধান করেন। তিনি জীবন-মৃত্যুর মালিক, সকল সমস্যার একমাত্র সমাধানদাতা। সুতরাং মহান আল্লাহ নিরাকার নন; বরং তাঁর আকার আছে।
(১) আল্লাহ বলেন, ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)।
(৩) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘ওটা এজন্য যে, আল্লাহ রাত্রিকে প্রবিষ্ট করেন দিবসের মধ্যে এবং দিবসকে প্রবিষ্ট করেন রাত্রির মধ্যে এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা’ (হজ্জ ২২/৬১)।
(৪) ‘হে নবী! তুমি
বল, তারা কত কাল ছিল, আল্লাহই তা ভাল জানেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান
তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা’ (কাহফ
১৮/২৬)। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীবকে আল্লাহ তা‘আলা দেখেন ও তাদের সকল কথা শুনেন।
তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না’।( তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/২৩২ পৃঃ।)
ক্বাতাদা (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর থেকে কেউ বেশী দেখেন না ও শুনেন না’।( তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২ পৃঃ।)
ইবনু যায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের সকল কাজকর্ম দেখেন
এবং তাদের সকল কথা শুনেন। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’।( তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২।)
বাগাবী (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীব যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের দেখেন এবং তাদের সর্বপ্রকার
কথা শ্রবণ করেন। তাঁর দেখার ও শুনার বাইরে কোন কিছুই নেই’।( মা‘আলিমুত তানযীল,
৫/১৬৫।)
(৫) আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূণ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘তোমরা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি’ (ত্ব-হা ২০/৪৬)। এখানে আল্লাহ মূসা ও হারূণের সাথে থাকার অর্থ হচ্ছে- তিনি আরশের উপর সমাসীন। আর মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর উভয়ের সাথে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
(৬) আল্লাহ আরো বলেন, ‘কখনই নয়, অতএব তোমরা উভয়ে আমার নিদর্শন সহ যাও, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শ্রবণকারী’ (শু‘আরা ২৬/১৫)। পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাই এখানে প্রযোজ্য।
(৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও গোপন পরামর্শের খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফেরেশতারা তো তাদের নিকট অবস্থান করে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন’ (যুখরুফ ৪৩/৮০)।
(৮) আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, তোমরা কাজ করতে থাক, আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন’ (তওবা ৯/১০৫)।
(৯) আল্লাহ বলেন, ‘সে কি অবগত নয় যে, আল্লাহ দেখেন’? (আলাক্ব ৯৬/১৪)।
(১০) আল্লাহ বলেন, ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (ছালাতের জন্য) দন্ডায়মান হও এবং দেখেন সিজদাকারীদের সাথে তোমার উঠাবসা। তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (শু‘আরা ২৬/২১৮-২২০)।
(১১) আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের কথা শ্রবণ করেছেন, যারা বলে যে, আল্লাহ দরিদ্র আর আমরা ধনী। তারা যা বলেছে তা এবং অন্যায়ভাবে তাদের নবীদের হত্যা করার বিষয় আমি লিপিবদ্ধ করব এবং বলব, তোমরা দহন যন্ত্রণা ভোগ কর’ (আলে ইমরান ৩/১৮১)।
(১২) আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সেই নারীর কথা, যে তার স্বামীর বিষয়ে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর নিকটও ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (মুজাদালাহ ৫৮/১)।
(১৩) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবাদেরকে বলেছিলেন, ‘তোমরা বধির কিংবা অনুপস্থিতকে ডাকছ
না; বরং তোমরা ডাকছ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ও নিকটতমকে’।( বুখারী হা/৭৩৮৬ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়,
অনুচ্ছেদ-৯।)
(১৪) আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘একদিন বায়তুল্লাহর
নিকট একত্রিত হ’ল দু’জন ছাকাফী ও একজন কুরাইশী অথবা দু’জন কুরাইশী ও একজন ছাকাফী। তাদের পেটে
চর্বি ছিল বেশি, কিন্তু তাদের অন্তরে বুঝার ক্ষমতা ছিল কম। তাদের একজন বলল, আমরা যা
বলছি আল্লাহ তা শুনেন- এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? দ্বিতীয়জন বলল, আমরা জোরে বললে শুনেন,
কিন্তু চুপি চুপি বললে শুনেন না। তৃতীয়জন বলল, যদি তিনি জোরে বললে শুনেন, তাহ’লে গোপনে বললেও শুনেন। অতঃপর আল্লাহ
তা‘আলা আয়াত
নাযিল করেন, ‘তোমরা কিছু
গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
দিবে না- উপরন্তু তোমরা মনে করতে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না’।( হা-মীম সাজদাহ ৪১/২২; বুখারী হা/৭৫২১
‘তাওহীদ’ অধ্যায়,
অনুচ্ছেদ-৪১।)
(১৫) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (হজ্জ ২২/৭৫)।
আবু দাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘এ আয়াতটিই হচ্ছে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের বাতিল কথার প্রত্যুত্তর। কেননা জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায় আল্লাহর নাম ও গুণবাচক নাম কোনটাই সাব্যস্ত করে না। সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা যে দেখেন-শুনেন এটাও সাব্যস্ত করে না এ ধারণায় যে, সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সাদৃশ্য হবে। তাদের এ ধারণা বাতিল। এজন্য যে, তারা আল্লাহকে মূর্তির সাথে সাদৃশ্য করে দিল। কারণ মূর্তি শুনে না এবং দেখেও না (মা‘আরিজুল কবূল, ১/৩০০-৩০৪)।
মু‘তাযিলা সম্প্রদায় বলে, আল্লাহর কর্ণ আছে কিন্তু শুনেন না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখেন না। এভাবে তারা আল্লাহর সমস্ত গুণকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ কোন গুণ-বৈশিষ্ট্য ছাড়া তারা শুধু নামগুলো সাব্যস্ত করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের মতবাদ জাহমিয়্যাদের মতবাদের ন্যায়। তাদের উভয় মতবাদই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কোন কিছুর সাথে তুলনা ব্যতিরেকে আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্ত করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে কুরআন-হাদীছ সাব্যস্ত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
আল্লাহ তা‘আলা
আরো বলেন, ‘সুতরাং তোমরা
আল্লাহর কোন সাদৃশ্য স্থির করো না’ (নাহল
১৬/৭৪)। আল্লাহ তা‘আলা
যে শুনেন, দেখেন, এটা কোন সৃষ্টির শুনা, দেখার সাথে তুলনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর
দেখা-শুনা তেমন, যেমন তাঁর জন্য শোভা পায়। এ দেখা-শুনা সৃষ্টির দেখা-শুনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ
নয়’।(মা‘আরিজুল
কবূল ১/৩০৪।)
আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য করা হারাম। কারণ (১) আল্লাহর যাত-ছিফাত তথা আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং সৃষ্টজীবের গুণ-বৈশিষ্ট্য এক নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা তার জন্যই প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা সর্বদা জীবিত আছেন ও থাকবেন। কিন্তু সৃষ্টিকুলকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। তাহলে কি করে আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের তুলনা করা যায়?
(২) সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করায় সৃষ্টিকর্তার মান-ইয্যত নষ্ট হয়। ত্রুটিযুক্ত সৃষ্টজীবের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ মহান আল্লাহকে তুলনা করা হ’লে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ত্রুটিযুক্ত করা হয়।
(৩) স্রষ্টা ও সৃষ্টজীবের নাম-গুণ আছে। কিন্তু উভয়ের প্রকৃতি এক নয়।
[চলবে]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন