রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১১

তিনি একজন নবী ছিলেন


প্রশ্ন : মাসিক আত-তাহরীক অক্টোবর’০৬ সংখ্যায় বলা হয়েছে যুল কিফল বনী ইসরাঈলের একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ছিলেন। ‘পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ২৫জন নবীর কাহিনী’তে বলা হচ্ছে তিনি একজন নবী ছিলেন। কোনটি সঠিক? দলীল ভিত্তিক জবাব দানে বাধিত করবেন।

উত্তর: যুল কিফল একজন নবী ও একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ছিলেন। পবিত্র কুরআনে তাকে নবীদের সাথেই উল্লে­খ করা হয়েছে (আম্বিয়া ৮৫-৮৬; ছোয়াদ ৪৮)। হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, যুল কিফলের নবী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট (তাফসীরে ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৫)
যুল কিফল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে দু’স্থানে বর্ণিত হয়েছে অন্যান্য নবীগণের সাথে যুক্ত করে। যেমন সূরা আম্বিয়া ৮৫-৮৬ আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا الْكِفْلِ كُلٌّ مِّنَ الصَّابِرِينَ، وَأَدْخَلْنَاهُمْ فِي رَحْمَتِنَا إِنَّهُم مِّنَ الصَّالِحِينَ- ‘আর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল কিফল, সকলেই ছিল ধৈর্যশীলগণের অন্তর্ভুক্ত’। ‘আর আমরা তাদেরকে আমাদের অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই তারা ছিল সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত (আম্বিয়া ৮৫-৮৬)। এ আয়াত দ্বয়ের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর বলেন, فالظاهر من السياق أنه ما قرن مع الأنبياء إلا وهو نبي- ‘পূর্বাপর সম্পর্কে এটা প্রকাশ্য যে, নবীগণের তালিকায় নবী ব্যতীত অন্যদের নাম যুক্ত হয় না’। তবে অন্যেরা কেউ বলেছেন, তিনি একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ছিলেন, কেউ বলেছেন, তিনি একজন ন্যায়পরায়ন শাসক ছিলেন। ইবনু জারীর এ ব্যাপারে চুপ থেকেছেন’। কুরতুবী ও শওকানী এখানে যুল কিফল সম্পর্কিত তিরমিযী বর্ণিত দু’টি যঈফ হাদীছ উল্লে­খ করে ক্ষান্ত হয়েছেন। আহমাদ, তিরমিযী, হাকেম-এর বর্ণনায় শুধু ‘কিফল’ এসেছে। আলবানী বলেন, ‘ইনি বনু ইস্রাঈলের একজন ব্যক্তি, কুরআনে বর্ণিত যুল কিফল নন(সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০৮৩)। কুরতুবী আবু মূসা আশ‘আরী (রা:) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছা:) থেকে একটি হাদীছ এনেছেন যে, إن ذا الكفل لم يكن نبيا ولكنه عبدا صالحًا ‘নিশ্চয়ই যুল কিফল নবী ছিলেন না। বরং তিনি একজন সৎকর্মশীল বান্দা ছিলেন’। অথচ হাদীছটি জাল, যার অবস্থা এই যে, لا أصل له في المرفوع بل موقوف ضعيف أخرجه الطبري وهو منقطع-  ‘এর মরফূ‘ হওয়ার অর্থাৎ রাসূল (ছা:) থেকে বর্ণিত হওয়ার কোন ভিত্তি নেই। বরং এটি মওকূফ, অর্থাৎ আবু মূসার নিজস্ব উক্তি। অথচ যার সূত্র যঈফ এবং যা ইবনু জারীর স্বীয় তাফসীরে মুনক্বাতি‘ অর্থাৎ ছিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন (তাহক্বীক্ব কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৫)
(২) আল্ল­াহ বলেন,
وَاذْكُرْ إِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَذَا الْكِفْلِ وَكُلٌّ مِّنْ الْأَخْيَارِ ‘আর তুমি বর্ণনা কর ইসমাঈল, আল-ইয়াসা‘ ও যুল কিফল সম্পর্কে। আর তারা সকলেই ছিল উত্তম ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত (ছোয়াদ ৪৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরতুবী বলেন, أي ممن اخةير للنبوة অর্থাৎ তারা ছিলেন সেই সকল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে নবুঅতের জন্য বাছাই করা হয়েছিল’। শাওকানী স্বীয় তাফসীর ফাৎহুল ক্বাদীরে বলেন, أنهم من جملة من صبر من الأنبياء- ‘তারা হলেন সেই সকল নবীগণের অন্তর্ভুক্ত যারা বহু কষ্ট সহ্য করেছেন’। অথচ একই তাফসীর গ্রন্থের সারসংক্ষেপ ‘যুবদাতুত তাফসীর’ নামে যা প্রকাশিত হয়েছে রিয়াদ, দারুস সালাম প্রকাশনী থেকে, সেখানে বলা হয়েছে, الصحيح أنه رجل من بني إسرائيل، كان لا يتورع عن شيئ من المعاصي فتاب فغفر الله له، ليس نبي، وقال جماعة هو نبي- ‘সঠিক কথা এই যে, তিনি বনু ইস্রাঈলের একজন ব্যক্তি ছিলেন। যিনি কোন পাপের কাজে দ্বিধা করতেন না। পরে তিনি তওবা করেন। অত:পর আল্লাহ তাকে মাফ করেন। তিনি নবী নন। তবে একদল বলেছেন যে, তিনি নবী’। প্রশ্ন হ’ল, এমন একজন লোকের কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বিশেষভাবে নবীগণের তালিকায় বর্ণনা করবেন কেন?
আত-তাহরীক অক্টোবর ২০০৬, ১০/৩ সংখ্যার ২১/২১ প্রশ্নোত্তরে যুবদাতুত তাফসীরের বক্তব্যটুকু অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে মাত্র। বাড়তি তাহকীক করার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। যেটা ভুল হয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় যে, আধুনিক মুফাসসির আবু বকর জাবের আল-জাযায়েরী স্বীয় ‘আয়সারুত তাফাসীরে’ সূরা আম্বিয়া ৮৫ আয়াতের তাফসীরের টীকায় লিখেছেন,
وأرجح الأقوال ما رواه أبو موسى رضي الله عنه عن النبي صـ أنه قال: ‘সব কথার সেরা কথা হ’ল যা বর্ণনা করেছেন আবূ মূসা (রা:) রাসূলুল্ল­াহ (ছা:) হতে’- বলেই তিনি যঈফ হাদীছটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন, যা মূলত: কোন হাদীছই নয়, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
মোটকথা কুরআন যখন ইসমাঈল, ইদরীস, আল-ইয়াসা
প্রমুখ নবীগণের সাথে যুল কিফলের নাম একসাথে বর্ণনা করেছে, তখন তিনি নবী ছিলেন, এ বিশ্বাসই রাখতে হবে। এর বিপরীতে কোন বিশুদ্ধ দলীল নেই। এগুলি ইহুদীদের মিথ্যা রটনা হওয়াও বিচিত্র নয়।
উল্লেখ্য যে, ইবনু কাছীর সূরা নেসা ১৬৪ আয়াতের তাফসীরে ‘যুল কিফল’ সহ ২৫জন নবীর তালিকা দিয়েছেন (ঐ, ১/৫৯৯ পৃ:)। কুরতুবী সূরা আম্বিয়া ৮৫ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন,
والجمهور على أنه ليس بنبي জমহূর বিদ্বানগণের মতে তিনি নবী ছিলেন না। কিন্তু সূরা ছোয়াদ ৪৮ আয়াতের তাফসীরে তিনি তাকে নবীগণের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। আসলে জমহূর পরিভাষাটি অনেক সময় ভেক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কুরতুবী, ইবনু কাছীর, শাওকানী প্রমুখ মুফাসসিরগণকে বাদ দিয়ে আর কাদেরকে জমহূর বলা হবে? আল্ল­াহ সর্বাধিক অবগত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন